গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১২


প্রশ্ন অন্ত হীন

তন্ময় দত্তগুপ্ত
                   
আসল নাম যে কি সেটা সে নিজেও ভুলে গেছে, তবে লোকে ডাকে আলি বলে না, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বা আলিবাবার  সাত রাজার ধন পাবার ঘটনা ওর জীবনে ঘটে নি। শৈশব থেকেই রোজগারের চিন্তা কেড়েছে ওর জীবনের নিস্পাপতা।ফ্ল্যাটের বাবু-বিবিদের মন জুগিয়ে চলাই ওর একমাত্র কাজ কখনও চা,কখনও বাসন মাজা, কখনও ইস্ত্রি , কখনও বা ‘নীল রতন এ্যাপার্টমেন্টে’র ছোট্ট ছেলে বুবাইয়ের সঙ্গে কথা বলা অন্যের মন জোগাতে জোগাতে সে ভুলে গেছে নিজের মনের ঠিকানা। গ্রামে বাবা মা বোন ওদের জন্য পাঠাতে হয় টাকা পাঠাতে হয় মাসে মাসে ব্যবধান ঘোচেনি কতটুকু আর পার্থক্য জীবনযাপনের ,সুখ দুঃখ,হাসিকান্না, আশা-আনন্দ, ঘৃণা-ভালোবাসার - কিছুই বোঝেনা আলি ।  এই সমস্ত প্রশ্ন মাঝে মধ্যেই ঘুরপাক খায় আলির মধ্যে,আবার দপ করে নিভেও যায় ভোর পাচটা থেকে রাত সাড়ে দশটা কিংবা  তারও বেশি সময় ধরে হাড়ভাঙা খাটুনি ভুলিয়ে দেয় , ভুলিয়ে দেয় সব মাঝরাতের চাঁদ কথা বলে সেই চাঁদ-এর ভেতরে আলি খুজে পায় নিজেকে সারা শরীরের ক্লান্তি কমে আবার কাল...আবার কাজ আবার বাবু-বিবিদের ফাই ফরমাস খাটা মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেসের  দয়া-দাক্ষিণ্যে দুপুর আর রাতের খাবার সূর্য তখনও হয়নি অহংকারী ঘড়ির কাটায় প্রায় সাড়ে দশটা । কাপ ডিশ ধুতে ধুতে আলির দৃষ্টি চলে যায় বাইরে। দূর-দিগন্তে হাইওয়ের রাস্তাটা সোজাসুজি চলে গেছে।কিন্তু কোথায় ? কতদূর ? যতদূর চলে গেছে ততদূরশেষ দেখা যায় না আকাশ আর মাটি যেখানে ছুই ছুই সেখানে চোখ চলে যায় আলির সোজা রাস্তার ডান ফুটে সাদা জামার ওপর ডোরাকাটা লাল জামা আর কালো প্যাণ্ট পড়া কিছু বাচ্চা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের বা হাতে ওয়াটার বটল আর পিঠে পড়ার ব্যাগ ডান ফুটে ওরকমই কিছু ছেলের দল তবে পোশাকের রং আলাদা সাদা শার্ট আর নীল হাফপ্যান্ট হাঁটতে হাঁটতে ওরা ক্রমশ মিলিয়ে যায় -- কি দেখছ আলি ? প্রশ্ন করে বুবাই
---আচ্ছা বুবাই ? এই সব ছেলেরা কোথায় যাচ্ছে ? 
--- কারা ?
--- এই যে একটু আগে দূরে কিছু ছেলে কাঁধে ব্যাগ আর হাতে জলের বোতল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল...
--- ও বুঝেছি কিন্তু মিলিয়ে যাবে কেন ? ওরা স্কুলে গেছে আলি দা
---স্কুলে ? প্রশ্ন আলির ...
--- হ্যাঁ স্কুলে আলি দা লাল জামা পরা যাদের দেখলে তারা পড়ে সেন্টবারনাবাস স্কুলে।আর সাদা জামা পড়া যাদের দেখলে তারা পড়ে বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে।
---
আচ্ছা স্কুল কেমন দেখতে হয় ?
--- এ আবার কেমন কথা ?
স্কুল স্কুলের মতোই দেখতে হয়
-- আচ্ছা বুবাই তুমিতো স্কুলে যাও
--- হ্যাঁ যাই
--- কি পড়ানো হয় স্কুলে ?
--- কি আবার পড়ানো হবে ? ইতিহাস,ভূগোল এইসব
--- ইতিহাস ভূগোল ! কি আছে ওতে ?
--- ইতিহাস হোল রাজা-রাজাদের গল্প , যুদ্ধ বিগ্রহ,এসবের খবরা খবরবুবাই যেন আলিকেই পড়ায়
আলির চোখে ভেসে ওঠে পাহাড়,সমুদ্র সেই সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় মাছ।লাল মাছ নীল হয়,নীল মাছ সবুজ,সবুজ মাছ বদলে গিয়ে এনে দেয় ভিন্ন জীবনের জিয়ন কাঠি। এ কোন্ ইচ্ছেপূরণের ইচ্ছা ! প্রশ্ন জাগে আলির সেই সঙ্গে আকাশে বাতাসে ছেয়ে যায় এক চিরন্তন স্বর--- তুমি যাবে ভাই,যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,গাছের ছায়ায় লতায়-পাতায় 
উদাসী বনের ছায় একটা বেসুরো শব্দে সম্বিত ফিরে পায় আলি হাতের কাপ ডিশ মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে চূর চূর
‘এ কি করলে আলি দা’ ? চমকে ওঠে বুবাই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বুবাইয়ের বাবা মিঃ রায়
--- কি হয়েছে রে বুবাই ? এ কি ! ভাঙ্গল কি করে ? নিশ্চয়ই আলির কাজ এ ই নিয়েতো অনেক হোল এবার মানে মানে বিদেয় হও,আজই...মিঃ রায় আলির হাতে পাঁচশ ধরিয়ে দেন । ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে আলি কাঁপাকাঁপা গলায় বলে---দুশো টাকা কম আছে । চোখ দুটো বড় বড় করে মিঃ রায় বলেন---‘এই দিয়েছি যে এই তোর ভাগ্য ভাগ এখান থেকে...’
          আলি মাথা নীচু করে দোতলা বাড়ি থেকে চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় রাস্তায় হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে ওঠে, ‘কি রে কাজ ছেড়ে দিলি’ ? আলি পেছনে ফিরে দেখে পরণে লুঙ্গি আর ডোরাকাটা গেঞ্জি পড়া একটা লোক দাঁত গুলো কালো কালো। মনে হয় দোক্তা খায় আলি 
জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কে ? আর জানলেই বা কি করে আমি কাজ ছেড়েছি’? ফিক করে হেসে ওঠে লোকটা ‘আমাকে সব জানতে হয় তুই যে ফ্ল্যাটে কাজ করতিস, তার পেছনে যে চায়ের দোকান,ওটা আমার আই তোর নাম কি রে’ ?
---আলি।
---আলি ! আলি কি ? যাগ্গে যাই হোক বলছি আমার দোকানে কাজ করবি ? আলি একবাক্যে হ্যাঁ বলে
--- ছশোটাকার বেশি এক পয়সা দিতে পারব না কি রে করবি ? আলি সামনের দিকে মাথা
নাড়ল। 
ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে সেদিন ধুঁয়ে দিচ্ছিল কলকাতার রাস্তাঘাট।একটাও খরিদ্দার জোটেনি চা করার কোনো তাড়া নেই দোকানে লাইন দিয়ে শিশি সাজান কোনোটার ভেতর বিস্কুট,কোনোটার ভেতর কেক। বৃষ্টির মধ্যে  আধময়লা ফ্রক পরা একটা মেয়ে এগিয়ে আসে 
দোকানের দিকে বলে ---‘একটা কেক দাও তো ? আলি শিশির ভেতর থেকে একটা কেক বার করে ওর হাতে দেয়’ মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে কতো দাম ? আলি বলে --- দুটাকা মেয়েটি 
পাঁচ টাকার কয়েন আলির হাতে দিয়ে চলে যায়। প্রথমে বোঝে না আলি পরে বোঝে বেশি দিয়েছে আলি মেয়েটির পেছন পেছন ছোটে।
--- আই শুনছ ? তুমি বেশি টাকা দিয়েছ আলি পকেট থেকে তিন টাকার কয়েন বের করে দেয়। কয়েনগুলো হাতের মধ্যে ঝাঁকিয়ে মেয়েটি বলে--- তোমার নাম কি?
--- আমার নাম আলি
--- তোমার ?
--- তিতলি
--- তিতলি মানে কি ?
--- তিতলি মানে হোল প্রজাপতি। -
-- তুমি উড়তে পার ? মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় তিতলির।
--- আমরা যারা কাজ করি, তাদের পাখা কাজ করতে করতে কবে যে পুড়ে যায় তা আমরা নিজেরাও জানিনা। কি করে উড়ব বল ? তিতলির মধ্যে আলি খুজে পায় নিজেকে
--- আমার সব কথা তুমি কি করে জানলে তিতলি ?  তুমি  কি আমি ? খুব জোরে হেসে ওঠে তিতলি ‘ধ্যাৎ তুমি না ভীষণ বোকা আমি কি করে তুমি হব ? তুমিতো ছেলে আমিতো মেয় হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে স্লোগান,‘যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই’ চমকে ওঠে আলি,’ওটা কিসের শব্দ’? 
--- তুমি জানোনা আলি ওটা একটা মিছিল’
--- মিছিল ? জানো আলি কোথায় যেন একটা মন্দির মসজিদ নিয়ে যুদ্ধ লেগেছে হিন্দুরা বলছে মন্দির তৈরী করবে,আর মুসলমানরা বলছে মসজিদ বানাবে’
--- হিন্দু-মুসলমান !
--- হ্যাঁ হিন্দু মুসলমান আমি তিতলি-হিন্দু আর তুমি আলি- মুসলমান।
--- কই আমরাতো যুদ্ধ করছি না তিতলি ?--- আমরা ছোট। ছোটরা যুদ্ধ করে না যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলে আর বড়রা সত্যি যুদ্ধ করে।
--- এত সব তুমি জানলে কি করে ?
--- অনিন্দ্য কাকু বলেছে।
-- অনিন্দ্য কাকু কে ?
--- আমিতো অনিন্দ্য কাকুর বাড়িতেই কাজ করি
... এই যাঃ, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কত সময় চলে গেল কাকু বকবে, চলি ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে মিলিয়ে গেল তিতলি তারপর কতদিন আলি চেয়েছিল হলুদ ওই ফ্ল্যাটের দিকে। কিন্তু দেখা মেলে নি তিতলির। বছরের প্রথম দিন,নববর্ষর হৈ হুল্লোড়ে মেতেছে কলকাতা আর ঠিক তখনই ঘটল একটা অঘটন অপ্রিয় নির্মম বাস্তব এলো আলির সামনে চায়ের দকানের মালিক বন্ধ করল দোকান অন্য ব্যবসা করবে সে তল্পি-তলপা গুটিয়ে আলি আবার হাটতে থাকে হাটতে থাকে অন্য  রাস্তায় একটা পাঁচিলে হেলান দিয়ে মাথা নীচু করে থাকে আলি ওর দুচোখ ভ’রে ওঠে জলে ঝাপসা চোখে দেখে নেয় সারা শহরটাকে না এখানে আর নয় গ্রামে ফিরতে হবে অনেকদিন দেখা হয়নি বাবা মা-কে কিন্তু ফিরবে কোন মুখে ? হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো এমন সময় আলির কাঁধে হাত রাখে কেউ একজন আলি পেছন ফিরে দেখে তিতলি
--- একি তিতলি তুমি ? এখানে  ! তিতলিরও দুচোখে জল
 --- আলি আমার কাজটা গেছে
 --- কেন তিতলি ?
--- সাতদিন টানা জ্বরে ভুগেছি কোনো কাজ করতে পারিনি তাই কিছুটা সুস্থ হতেই চলে যেতে বলল
--- তিতলি তুমি বাড়ি ফিরে যাও
--- আমার কেউ নেই আলি
--- তিতলি তুমি কি অন্য বাড়িতে কাজ খুজবে ?
-- কাজ খোঁজা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ নেই’, তিতলি বলে
আলি তাকিয়ে দেখো ‘সারা আকাশ মেঘে মেঘে ঢেকে গেছে ।  আকাশে আজ আমাদের সেই প্রিয় চাঁদ আর নেই চাঁদও কাজ খুজতে গেছে পূর্ণিমার রাতকে গ্রাস করেছে অমাবস্যা রাস্তার নিয়ন আলোগুলো কোনোটা জ্বলছে কোনোটা নিভছে
কৌতুহলী চোখে আলি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ‘না তিতলি আমার মনে হয় চাঁদও স্কুলে গেছে আচ্ছা তিতলি, আমরা কবে স্কুলে যাবো’ ?
এপ্রশ্নের কোন উত্তর তিতলির কাছে থাকার কথা নয়। হয়তো কারো কাছেই নেই ।

রংছুট

শুভশ্রী সাও

ব্যালকনি তে হেলান দিয়ে বৃষ্টি আরো একবার ভোর হওয়া দেখলো । দেখলো রাতের অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়ার ঐ প্রিয় লাল টাও কেমন গা গোলানো হতে পারে ! সঙ্গে সঙ্গে এও মনে পড়ে গেলো- ছেলেবেলায় ঠিক কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙের মিশেলে আরো একটা নতুন রং পাওয়া যায়, বৃষ্টি বুঝতে পারতো না । বৃষ্টির দিভাই কিন্তু ঠিক বলে দিতে পারতো আর কেবল বলতো, “জানিস বৃষ্টি লাল আমার ভীষণ প্রিয় । লাল দেখলেই আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে”....... হ্যাঁ লাল । যে লাল এখন এই ছোট্ট ফ্ল্যাট টা কে বড় বেশি নীল করে দিয়েছে !! কালশিটে পড়েছে দেওয়ালের প্রতিটি কোনায় কোনায় । ঠং করে আওয়াজ হোল একটা, বৃষ্টি ত্বরিত গতিতে দক্ষিণের শোয়ার ঘরের দরজায় । জল খাওয়ার গ্লাস টা নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে , বাইশ বছরের মেয়ে টার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছেসাদা চাদর টা লালে ভিজে আছে আবার ! যন্ত্রণায় ভীতিতে কাতরাচ্ছে বৃষ্টির আদরের দিভাই । এই তো আমি এসে গিয়েছি দিভাই...... কিচ্ছু হয়নি এই যে আমি এসে গিয়েছি বৃষ্টি ওর দিভাই এর মুখ টা কে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রাখে গলার মধ্যে দলা পাকানো কান্না টা কে গিলে নিতে নিতে!

         হ্যালো ডক্টর আঙ্কেল,আমি বৃষ্টি বলছি, আজ সকালে দিদির আবার ঐ একই ভাবে ব্লীডিং হয়েছে । আপাতত একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছি তুমি একবার আসবে প্লিজ?”আগে বললি না আমায় ? আমি এক্ষুনি আসছি রে মা, তুই চিন্তা করিস না না চিন্তা করে না বৃষ্টি, তারা কেউই চিন্তা করেনা অপেক্ষা করে শুধু, যার শুরু টাই শুধু দেখতে পাওয়া যায় !
          ড্রয়িং রুম এর বড়ঘড়ি টা জানান দ্যায় ৪ টে বেজে গেছে  রাতুল এর আসার সময় হয়ে গেলো । রাতুল, রাতুল মুখার্জি- জেম অফ আ বয় ! জেলা স্কুলের ফার্স্ট বয়, দুরন্ত তার ফুটবল স্কিল, আসাধারন গানের গলা আর কলম ধরলে তা থেকে সোনার এক একটা লাইন বেরোয় । বৃষ্টির দিভাটাকে যে বছর রাতুল প্রপোজ করলো, বৃষ্টির সেদিন মনে হয়েছিলো সেই বুঝি প্রেমে পড়েছে! একটা গা সিরসিরে অনুভূতি, মাঝরাত্তিরে দুজনের হা হা হি হি মিস্টার অলোক চ্যাটার্জি খুব ধমক দিয়েছিলেন ইয়ার্কি হচ্চে রাত দুপুরে ? পড়াশুনো তো সব মাথায় তুলেছো  মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে থাকবে যাও , রাতদুপুরে হা হা হি হি করবে না দু বোনই মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিলো- না মানে ভুল হয়ে গেছে বাবি....সরি তোমার ঘুম ভাঙালাম। শুয়ে পড়ছি আর কক্ষনো হবে না দেখোদরজা বন্ধ হয়েছিলো সঙ্গে সঙ্গেই আর মুখে বালিশ চাপাও পড়েছিলো ঠিকই তবে ঘুম আসবার জন্য নয়,ঐ ফোয়ারার মত হাসি টা কে চাপা দেওয়ার জন্য !

          কতো তাড়াতাড়ি দিন গুলো বদলে যায়, কতো দ্রুত রং পাল্টায় এ জীবন দরজায় পরিচিত মৃদু টোকার আওয়াজে ঘোর ভাঙ্গে বৃষ্টির,-রাতুল এলো। এই সময় টা সে প্রতিদিন তার প্রিন্সেসকে কবিতা শোনাতে আসে। প্রিন্সেস কমলিনী চ্যাটার্জি। ওদের মেডিক্যাল কলেজের বন্ধুরা সব ঠাট্টা করে বলতো মানিকজোড় একসঙ্গে কবিতা পাঠ, গান আবৃত্তি সবেতে রাতুল-কমলিনী। যেদিন ঘটনটা ঘটলো সেদিন যে কেন একসঙ্গে ছিলো না ওরা ? কেন সবেতেই জিতে যাওয়া ছেলেটা সেদিনই হারলো? আর এমন হারলো যে নিজের চোখের দিকে তাকাতেও ভয় হয় আজকাল তার আর কেউ না বুঝুক, বৃষ্টি সব বুঝতে পারে বুঝতে পারে সব হারানোর দৃষ্টি
মাখা ছেলেটা তার প্রিন্সেস এর ঘরের সামনে ঢোকার আগে কি ভেবে নিজেকে আমূল বদলে নিতে পারে! আর অবাক হয়ে দ্যাখে ওর রাতুল দার কাণ্ডকারখানা। ঢুকেই রীতিমত ফিল্মি স্টাইল এ- কি জান ? আজকেও সেই মুখ টা ৫ ইঞ্চি ঝুলিয়ে আছিস ? আরে রাতুল এসেছে রাতুল.........পারমিতা টা কি ধরেছিল মাইরি, একা একা বোর হচ্ছে নিজের হাতে আবার কুলফি বানিয়েছে। খেলে নাকি ভুলতে পারবো না। একবার ভাবলাম বুঝলি, যে যাই একটু চেখে আসি”- বলেই একটা ফিচেল হাসি, তুরন্ত জবাব আবার নিজেরই- আরে না না কমলিনী আছে না, ম্যাডাম কে দেখলে মনে হয় কিচ্ছু জানে না......রেগে গেলে সে তখন ঝাঁসি কি
রানী। রাতুল এর কুলফি বানাতে তার দু মিনিট ও সময় লাগেনা, তাই চলেই এলাম
বুঝলিতারপরই জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে এমন ভাবে বই টা বের করবে যেন খাপের
বলেই জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে এমন ভাবে বই টা কে বের করে আনবে যেন খাপের
ভেতর থেকে তরোয়াল বের করে আনলো। আজ জয় বাবুকেই নিয়ে এলাম সঙ্গে
করে,শক্তি বাবু কে নিয়ে নাহয় আরেকদিন বসবো , কি বুঝলি প্রিন্সেস?” তারপর
একের পর এক কমলিনীর পছন্দের কবিতাকখন যেন গোধূলি বিকেল টা আস্তে
আস্তে মলাটে ঢেকে নেয় নিজেকে ঘরের সাদা আলোটার বলিষ্ঠ মুঠোয় বন্দীহয়ে পড়ে থাকে নীরব ভালোবাসা! মেয়েটা যে বড্ড কবিতা পাগল !তার কবিতার বই এর কালেকশান যে কাউকে হার মানাতে পারে। অথচ, এই কবিতা গুলোও তাকে নাড়াতে পারে না আর।

         স্থির চেয়ে থাকা সিলিং এর দৃষ্টি টাও নড়ে না একটুও তবু ডাক্তার বলেছে-মেয়ে টা যা যা ভালোবাসতো তাই যেন করা হয় ঐ ভয়টা কাটানো দরকার তাই তারা সবাই চেষ্টা করছে, যে অলোক চ্যাটার্জির মেয়ের ক্ষত বিক্ষত, বেয়াব্রু ও প্রায় অর্ধমৃত শরীর টা কে দেখে সজোরে একটা থাপ্পড় কষিয়েছিলো রাতুলের মুখেআজ সেই মানুষ টাই অপেক্ষা করে কখন রাতুল আসবে ! কেননা তার বড়মেয়ে - ঐ হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়া বড় মেয়ে টা মাঝে মাঝেই রাতুল রাতুল বলে চিৎকার করে ওঠে এবং কোনো কোনো দিন ঐ রাতুলের কবিতা শুনেই ঐ স্থির চোখেও দু ফোঁটা জল চিকচিক করে ! হতে পারে, হতেই পারে আবার হয়তো কোনো একদিন এভাবেই সে চেঁচিয়ে উঠবে, দমফাটা কান্নায় ফেটে পড়বে আর ফিরে যাবে স্বাভাবিক জীবনে ! আর রাতুল বলে ছেলেটা ? সে ভাবে---কেন আগলাতে পারলো না সে তার প্রিন্সেস কে ? সেদিনই তার না থাকা টা এত কষ্ট দিলো মেয়েটা কে ? কতবার কতবার ডেকেছিলো কমলিনী তাকে, যখন ঐ জানোয়ার গুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ভাবে আর কানে বাজে একটা সুরেলা রিনরিন স্বর-বীরপুরুষ আমার”......কমলিনী বলতো, যখন রাতুল মুখার্জি অতিমাত্রায় অধিকার সচেতন হয়ে মেয়ে টাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে চাইতো । পুরুষ্টু ঠোঁট দিয়ে চেটে নিতে চাইতো নরম পাপড়ির মত ঠোঁট দুটো কে আর কামড়ে ধরলেই ভয়ে সরে যেতে যেতে বলতো না, বাবার চোখে পড়ে যাবেজোর করতে করতে তার বীরত্ব দ্যাখাতে চাইতো হ্যাঁ বীরপুরুষ ই বটে ! হাসে, হা হা করে হাসি পায় রাতুলের রাগে মুঠো করা হাত টা কে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে , লজ্জায় ঘেন্নায় মরে যেতে ইচ্ছে করে ! নিজেকে মেরুদণ্ডহীন বলে মনে হয়। পরক্ষনেই কে যেন বলে ওঠে রাতুল তুই ই পারবি , তোকেই, তোকেই বাঁচাতে হবে ঐ মেয়েটাকে । মেয়েটা যে বড় বাঁচতে চাইতো ভালোবাসতে চাইতো তোকে…… কতো স্বপ্ন দেখেছিলো মেয়েটা ? সেগুলো পূরন করতে হবে তো ? আর বৃষ্টি ? কমলিনীর মিষ্টি বোনু টা, হঠাৎ করেই তার দিভাই এর চাইতেও বড় হয়ে গেছে ! গত কয়েক দিনের অসহ্য যন্ত্রণা তাকে বলেছে লাল দেখে ওয়াক তুলতে ইচ্ছে করলে তুলবে নিশ্চয়ইতবে ধরা পড়ে গেলে হাসিমুখে একটা হজমের ওষুধ খেয়ে নিতে ভুলো না !

          পাঁচটা মাস কেটে গিয়েছে কমলিনীর টেবিলের ওপরটা আরো একটু রঙিন হয়েছে। বাকী সব যেমন কার তেমনি। মিস্টার চ্যাটার্জি বাড়িতেই যা যা ব্যাবস্থা করা যায় করে, মেয়ে কে নিজের কাছেই রেখেছেন। দক্ষিণের ঐ ঘরটা দেখলে বোঝা মুশকিল ওটা শোয়ার ঘর নাকি হসপিটাল এর কেবিন! রাতুল নিয়ম করে আসে যায়। আজকাল আবার একটা করে কবিতা লিখে নিয়ে আসে। যাবার সময় জোর করে তার প্রিন্সেস এর হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। ঘরময় উড়ে বেড়ায় সেগুলো আর বৃষ্টি কুড়িয়ে কুড়িয়ে রাখে। যে কাঠের সুন্দর বাক্স টা বৃষ্টির দিভাই কোনো এক জন্মদিনে বৃষ্টি কে দিয়েছিলো, বৃষ্টি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলো রাতুল দার মতো তাকেও কেউ যখন ভালোবাসবে তার দেওয়া চিঠি গুলো ঐ সুন্দর বাক্স টা তে বন্দী করে রাখবে। এখন ঐ বাক্স টাতেই একটার পর একটা কবিতা জমা হচ্ছে ! একটা করে ভোর হয় , বৃষ্টি তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে - দ্যাখে অন্ধকারটা ফিকে হয়ে আসলেই উঠোনের এর গেট এর কাছে ঐ কৃষ্ণচূড়া গাছটা কেমন গাড় হয়ে ওঠে আর ধুলোয় ঢেকে যাওয়া রাস্তা টা কে লালে ভরিয়ে দেয় ! বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে----তার ঘুমোবার সময় হয়ে আসে একটু ঘুমোতে চয় সে কানের মধ্যে  বেজে যায় রাতুল এর ভরাট গলায় কমলিনীর প্রিয় কবিতার কয়েকটা লাইন...
আমার কাছে আসতে বলো একটু ভালোবাসতে বলো বাহিরে নয় বাহিরে নয়
ভিতরে জলে ভাসতে বলো--- আমায় ভালোবাসতে বলো ভীষণ ভালো