গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২


টুবুদির বিয়ে ।
 মধুছন্দা পাল
        জ্যাঠামনির  বড়  মেয়ে  আমাদের সবাইয়ের বড়দি । কলকাতার  আশেপাশে  কোন ছোট   আধা শহরে থাকতো,   মাঝে  মাঝে বাপের বাড়ী আসতো । খুব ভালো মানুষ , শান্ত শিষ্ট  ছিল অনেক গল্প বলত  আমাদের । । জামাইবাবু  ছিলেননা   আমার যখন থেকে মনে পড়ে  সাদা শাড়ীতেই  দেখেছি । বেশ কয়েকটি ছেলে মেয়ে ছিল বড়দির ।  দুএকজন  আমাদের কাছাকাছি  বয়সের ছিল , আমাদের ওখানে থেকেই পড়াশোনা  করতো ।
        সেই বড়দির  মেয়ে  টুবুদি । যতদুর  মনে হয় আমার দিদি,রাঙ্গাদিদের বয়সি কারণ ওদের সঙ্গে  খুব ভাব ছিল । তো সেই টুবুদির বিয়ে । আমাদের বাড়ী থেকেই হবে । দিদিদের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল , টুবুদির বিয়ে একটু দেরি করেই ঠিক হয়েছিলো মনে হচ্ছে ।
        পাত্র, বিহারের গ্রামের ডাক্তার , নাম গোপাল ।  বোধহয় আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ ছিলনা,  কারণ বিয়ে করতে একলাই এসেছিল যতদুর মনে পড়ছে । আর আমাদের বাড়ীতেই  বৌভাত, ফুলশয্যা  ইত্যাদি  হয়েছিল 
                 গোপাল যে অতি সুবোধ বালক  একেবারে অক্ষরে অক্ষরে  প্রমাণ করে দিল বর   মুখে কোন কথা নেই । সেটা অবশ্য বহুদিন বিহারের   দেহাতে থেকে   বাংলা ভাষা বলার অভ্যেস চলে যাওয়ার কারনণও হতে পারে ।  বিয়ের  নিয়ম কানুন  করাতে গিয়ে  নানারকম  হাস্যকর   পরিস্থিতি তৈরি করছিল , আর  জোরে জোরে হাসির হররা উঠছিল ।  একটা ব্যাপার মনে আছে । বিয়ের সময় কয়েকবার শিলের ওপর দাঁড়ানোর  নিয়ম আছে,  বর শিলের ওপর উঠেই ধপ করে বসে পড়ছিল । একবার নয় বারবার , পিঁড়িতে উঠেও    একই ঘটনা । সেই সব  নিয়ে খুব হাসল মেয়েমহল
        আমরাই বা  পিছিয়ে থাকি কেন ? বরের কাছাকাছি  গিয়ে গোপাল গোরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে ......বলে তার যাকে বলে ঠ্যাং টানা  তার  চেষ্টা করা । তবে বর কিছু  বুঝছিল বলে মনে হয়না । আমরা বললাম বটে,আমি সঙ্গে থাকা ছাড়া আর কিছু করিনি , মায়ের কানে গেলে  যে কপালে দুঃখ আছে তা জানতাম ।  টুবুদির ভাই বোনেরাই  অনেক ভাবে হয়রান করার চেষ্টা  করছিল । ওদের অধিকারও ছিল অবশ্য । বয়স যাই হোক সম্পর্কে আমি শ্বাশুড়ী ।  
 যা হোক , বিয়ে  মিটে  গেলো ভালোয় ভালোয় ।  আগেই বলেছি   টুবুদির ফুলশয্যা আমাদের বাড়ীতেই  হয়েছিল । সেদিন গভীর  রাতে চোর ঢুকলো বাড়ীতে ।     

         গরমকাল , যে যেখানে পেরেছে  শুয়ে পড়েছে । টুবুদিরা  তিনতলায় জ্যাঠাইমার ঘরে । বাকি দুটো ঘর  খালি, বাইরে থেকে বন্ধ । ওরাও  দরজা খোলা রেখেছিল মনে হয় । তো চোর  ঢুকলো  গিয়ে  টুবুদিরা যে ঘরে  শুয়েছে সেই ঘরে ।  ঘরে ঢুকে  খাটের নীচ থেকে যখন টেনে বার করেছে স্যুটকেশ সেই আওয়াজে  ঘুম ভেঙে  উঠে  টুবুদি দেখে   মেঝেতে  চোর  বসে  চোর  নাকি টুবুদিকে  দেখেই  এক বিরাট  দাঁত খিঁচুনি  দিয়েছিল ভয়  দেখানোর  জন্যে ।  টুবুদি    তারস্বর  চোর চোর  চিৎকার শুনে বাড়ীর  লোকজন উঠে  চোর ধরার জন্যে   ছোটা ছুটি শুরু করলেও  ধরা তত সহজ ছিলনা । সব জায়গার আলো  তেমন জোরাল  ছিলনা   ছোটকাকার  একটা  পাঁচ ব্যাটারির  টর্চ ছিল, সেটা দিয়ে  চোর  খোঁজাখুঁজি চলল  মাঝে মাঝে দেখা যায় আবার কোথাও লুকিয়ে পড়ে।
        আমাদের মেজজ্যাঠা বাবুর  সারারাত জেগে বই পড়ার  অভ্যাস ছিল  একটু অদ্ভুত  মানুষ ছিলেন  ভালো ডাক্তার  হওয়া সত্ত্বেও  কোনদিন  প্র্যাকটিস  করেননি । এক পিসিমা ছাড়া  কারো সঙ্গে কথা বলতেননা  বড় একটা ।  তো বারান্দায়   আড় হয়ে  শুয়ে কাছে একগাদা  মেডিক্যাল  জার্নাল , পড়ে রয়েছে , মাথার কাছে একটা লন্ঠন   বারান্দার আলো যথেষ্ট  জোরাল  নয় পড়ার পক্ষে তাই একটা লন্ঠনের  ব্যবস্থা থাকতো   শেষ  পর্যন্ত চোরকে দেখা গেলো হাতে একটা ছোট ছুরি সেটা   ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে  মেজজ্যাঠাবাবুকে  ডিঙিয়ে  যে পথে এসেছিলো সেই দিকে দৌড়ল  বাধ্য হয়ে আর সবাইও অগত্যা  মেজজ্যাঠা বাবুকে ডিঙিয়েই।  ছোটোকাকা  লন্ঠনটা তুলে নিল  ছুটল  চোরের পেছনে ।  মেজজ্যাঠাবাবু নির্বিকার । চোর  দোতলার  ছাদের  পাঁচিল  ডিঙিয়ে  পাশের বাড়ীর  পোড়ো জমিতে লাফিয়ে পড়ে  পালানোর  আগে  যে হাত দিয়ে  ছাদের পাঁচিল  ধরে রেখেছিল   ছোটোকাকা  সেই হাতের ওপর  লন্ঠনটা  বসিয়ে দিল । চোর অনায়াসে  হাত টেনে বার করে  নীচে  লাফিয়ে  পড়ে পালিয়ে গেলো
        চোর পর্ব মিটতে মিটতে প্রায় ভোর  আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখিকা  লীলা মজুমদার  বলেগেছেন  ছোটদের নাকিবিশেষ  রকম  বড় বড় কান থাকে  তাই দিয়ে তারা অনেককিছু শুনতে পায় । সেই কান দিয়ে আমি শুনলাম  এবং দেখলামও   টুবুদির হাতে একটা নতুন আংটি । ওটা নাকি বরের   দেওয়া । আংটি  পরানোর  কাহিনীও  আমার  বিশেষ  কান দিয়ে শুনেছিলাম  যখন দিদি, রাঙাদিরদের চাপাচাপিতে ওদের  কাছে গল্প করছিল ।  টুবুদির সঙ্গে বরের আলাপ হয়নি । রাতে মটকা মেরে পড়ে থাকা টুবুদি হঠাৎ  টের পেল  বর হাত ধরে টানছে  তাকিয়ে দেখে  বর উঠে বসে   আংটি পরানোর চেষ্টা করছে  টুবুদিকে  ধড়মড় করে উঠে বসতে দেখে  বর নাকি কাজ অসমাপ্ত রেখেই ধুপ করে শুয়ে পড়েছিল , আর  টুবুদি নিজেই বাকিটা কাজটা নিজেই সেরে নিয়েছিল ।
        টুবুদি খুব সুখী হয়েছিলো ।  দুটো ছেলে হয়েছিল একদম বিহারের মানুষ । বড়টার নাম ছিল কুমার । লালচে চুল , ফুটফুটে  দেখতে । নাম জিজ্ঞেস করলে  বলত  “কুমার বাওখানে  গ্রাম্য লোকেরা  ঐ ভাবেই নাম বলে থাকে । আমরা মজা করে বার বার নাম জিজ্ঞেস করতাম ।
[মধুছন্দা পাল - জন্ম বিহারে, এখন থাকেন বরোদা, গুজরাটে । নিজেকে কবি, গল্পকার বা লেখক কিছুই বলতে এখনও অনীহা মধুছন্দার, কিন্তূ দারুণ সাহিত্য অনুরাগী লেখেনও হৃদয় দিয়ে । কৈশোরের টুকরো টুকরো স্মৃতি গদ্যের আকারে নিয়মিত লিখে চলেছেন তিনি । সেই স্মৃতির কোনো টুকরো কখনোবা গল্পের রূপ নিয়ে নিচ্ছে , 'টুবুদির গল্প' সেরকমই এক টুকরো স্মৃতি ।]