গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

৩২ তম সংখ্যা ৩টি গল্প 'অথঃকামিনী আখ্যান / মিত্রপক্ষ সাই, অল্প-স্বল্প গল্প গাথা' / মৌ দাশগুপ্তা, ও 'সময়' / ডঃ কাকলী মুখোপাধ্যায়




অথ : কামিনী আখ্যান


মিত্রপক্ষ সাই









কামিনী গাছটার আজকাল বড্ড দেমাক হয়েছে।


দুষ্টু মিষ্টি এমন একটা নাম নিয়ে আজীবন সুড়সুড়ি দিয়ে গেছে আমায়। এখনও বুঝলাম না এই সাদা ফুলটার নাম কামিনী কে রেখেছিল। এমনটাও হতে পারে নির্ঘাত সদ্য বিধবার প্রেমিক ছিল ব্যাটা। সিনেমার নায়িকাদের সাদা শিফনের শাড়ি পরে বৃষ্টি ভিজতে দেখেছি। এছাড়া আমি কস্মিনকালেও কোন সাদা কামিনীকে দেখিনি আমার ইঁদুর চোখে।
আসলে সোজাসুজি কামিনীর দিকে তাকাতে লজ্জা পাই। বেবাটের মতো লাগে আমায়। আবেগের ট্রাফিকে অকারনে হাজির হয় সার্জেন্ট। ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দেখান তো!
গত দুই দশক ধরে এপ্ল্যাই ফর স্ট্যাটাসে আছে! হাজার টাকা ফাইন। কোনমতে তিনশ তে রফা করে নমস্কার দেই। এ বড়দের জিনিষ, তোমার জন্য নিষিদ্ধ বাছা, কষ্ট পেয়োনা। আরেকটু বড় হও, স্ট্যাটাস কনফার্ম হবে, তখন দেখ।
তাই আমি বলি আমার মন ইঁদুর চোখা। ঈশ্বর চোখটাও দিলেন না ঠিকঠাক। সব অনাসৃষ্টি আমার মধ্যে ঢেলেছেন অকাতরে। কে জানে কোন কালে ওনার প্রেমিকাকে দেখেছিলাম কিনা কোন ট্রাফিক সিগন্যালে। তাই আমি শাপগ্রস্ত ইঁদুর চোখা হলাম কিনা! স্বপ্নেও দেখতে পাইনা কামিনীর শরীর, সমস্যা একটাই ঐ আমার ইঁদুর চোখ আর ট্রাফিক সার্জেন্ট এন্ড হারু স্যার।


একবার ক্লাশ এইটে বর্ণালীর বইয়ের পাতায় রেখে দিয়েছিলাম কামিনি ফুলের গুচ্ছ। ঐ বয়সটায় এতো আইন কানুন জানতাম না তো! সে তখন ক্লাশ ফাইভ। জলে বাঁশের অঙ্ক মুছে গিয়েছিল। আমার জল বাঁশের খেলা সেদিন পাক্কা করেছিল এই কামিনী ফুলের গুচ্ছ। বর্ণালীর বই হয়ে আমার পিঠে হারু স্যারের বাঁশের কঞ্চি, কামিনী ফুলের পুষ্প বৃষ্টি বলার কোন কারন নেই। মা তেল মাখাতে মাখাতে অভিসম্পাত করেছিলেন হারু স্যার কে। আমার ছেলের গায়ে হাত! দেখে নিস কি হয় তার। নিজের তো একটা ছেলে নেই। মায়ের অভিসম্পাতে ব্যাথা কমে গিয়েছিল, ভ্যাবলার মতো কেঁদেছি আমার কামিনী ফুলের জন্য। মার খেয়েও সেদিন মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ক্লাশে ফিরেছিলাম আমার কামিনী ফুল। লাল চোখে কামিনী ফুল হাতে নিয়ে বসেছিলাম কাঠের বেঞ্চে। কেউ ছিল না, পিকলুদা এসে তেঁতুলের আচার দিয়েছিল কাগজে করে। তখন খাইনি রাগে, তবে ও চলে যেতেই কাগজ শুদ্ধ পকেটে পুরেছি। আর শুধু কেঁদেছি। ভেবেছিলাম কাঁদলেই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে বর্ণালী, বলবে আর কেঁদোনা, আমি তখন ওকে আদর করে দেব পত্রিকায় মোড়া তেঁতুলের আচার।


টিফিন টাইম চলছিল, আড় চোখে বর্ণালী এসে উঁকিও দিল। আধ খোলা বেতসের মতো পিঠে বেত মারার দাগ। ঠিক পঞ্চাশ বেত, গুনে গুনে। পিকলুদা গুনেছে আর আমি পিঠ পেতেছি, হারু স্যার মেরেছে, মধ্যে একবার জিরিয়েছে নিভু বিড়ি জ্বালাতে। সেদিন অভিশাপ দিয়েছিলাম আজ সাইকেল এক্সিডেন্টে মরবে হারু। দিব্যি বেঁচে আছে আজও। তিন ছেলের বাপ হয়েছে।


সেদিনও চোখ তুলে তাকাতে পারিনি বর্ণালীর দিকে। জিভ বের করে ভেংচে দিয়ে বলেছিল, এত্ত বড় ছেলে কেমন কাঁদে দেখো। একটা চকোলেট ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়েছিল। ব্যাথা আরও বাড়ে, আমার চোখের তরল, নাকের ঘন পদার্থের সঙ্গে মিলেমিশে ঠোঁটে গড়াগড়ি খায়। স্যার এসে অংক ধরবে শুনেই অবশ্য পরের ক্লাস পর্যন্ত এই শোক রাগ চালিয়ে গেছি। অ্যা... অ্যা...। পড়া ধরতে হারুর ব্যাটা সামনে এলেই আবার রাগরাগিণী সঙ্গে তরল পদার্থের ফ্যাত ফ্যাত।
সেদিন থেকে কামিনী ফুল আমার সঙ্গী। এরপর অনেকদিন আর দেখিনি বর্ণালীর দিকে। দেখলেই মনে হতো তাকিয়ে আছে হারু স্যার।


বাইশে শ্রাবনের সন্ধ্যায় মঞ্চে হঠাৎ দেখি আমার ক্লাস সিক্সের বর্ণালীকে। দীর্ঘ দুই যুগ উত্তীর্ণ। এখনও বুকের ভেতরটা কেমন জানি কেঁপে কেঁপে উঠে। আজকাল একটু বড় হয়েছে আমার চোখ। মানে মেয়েদের দেখলে চোখ ঘুমিয়ে থাকেনা, পিটপিট করে। উন্নতি যে হয়েছে নিজেই টের পাই। চুলে সেই কামিনী লতা জড়িয়ে গাইছে 'তোমার কাছে এবর মাগি...মরণ...' আমার অনেক কাল আগেই মরণ হয়েছে সখী, আর ফিরেও তাকাই না তো। আবার কেন! আরেকবার চাইছে নাকি হারু পর্ব! আমার চোখে চোখ রেখে গেয়ে যাচ্ছে কেন! মরণ চাহি...। কি সাঙ্ঘাতিক! বাতাসে বারুদের গন্ধ! ঈশ্বর কোথা যাই এবার! আমার বাইশে শ্রাবন টের পেয়ে কেটে পড়লাম। যদি চেয়ে বসে সত্যি সত্যি ঐ মরণ টাইপ কিছু!
পিঠের ব্যাথা এখনও হয় সুন্দরী। তাই আর চান্স নেবোনা। সিগারেট ছাড়া নিজের সঙ্গে কেউ থাকেনা এইসব দুখ্যু দুখ্যু মুহূর্তে। ইঁদুর চোখে বর্ণালীর গ্রাফিকাল একটা ইমেজ তৈরী করে নিলেও, খুব বেশী একটা পাত্তা দিইনি। নিজেকে বেশ ড্রাইভিং লাইসেন্স টাইপ লাগছে। এখন আমি ফলন্ত। আজকাল কামিনী, জুঁই, জবারা আমায় সারাদিন ইনবক্সে আদর করে। আমার কাতুকুতু লাগে সারাদিন। বৌদি আর নেবা মানে আমার পোষা একটা ইঁদুর আছে দুজনেই আমার সাক্ষী।
কেমন আছো?
এই রে! ঘাবড়ে গেলাম। আমার সামনে যমদূতের বউ। তবে সুন্দরী। এই প্রথম বর্ণালীর মুখোমুখি আমি। প্যানেল ডিসকাশনের অফার দেবে নাকি! শুনেছি একটা চ্যানেলে খবর পড়ে। আমি যা ভাবি তাই হয়। আজ আমার বাইশে শ্রাবন হবে পাবলিকলি। আমি নিশ্চিত। হারু স্যারের বেত মনে পড়ে গেল। আশেপাশে কেউ নেই তো!
না আজ অন্য ভাষায় কথা বলছে ক্লাশ ফাইভের বর্ণালী। আবার ছলকে উঠলো আমার বুকের মধ্যে একগাদা মুরগীর বাচ্চা। মনটা কোনদিন আমার বশে থাকেনা। যখন খুশী ঝরে পড়বেই, লাজলজ্জা নেই এতটুকু। তবে আজ আমার ইঁদুর চোখ সামলালাম, পিটপিট করছে না টের পাচ্ছি।
- হুম ভালো, মুরগী টাইপ উত্তর দিলাম কোনমতে। পাল্টা একটা কালাম মিশাইল আমিও ছাড়লাম। বিয়ে হয়ে গেছে!
- এখনও তাকাতে পারো না আমার দিকে নাহ! মোবাইল নম্বরটা দাও।
- ভুলে গেছি।
- কি! নিজের নাম্বারটাই ভুলে গেছো? হারু স্যারকে মনে আছে!
এ দেখি মনমোহিনী ইস্তেহার। ভরিয়ে দিচ্ছে একদম। নির্বাচন তো হয়েই গেছে, আবার কেন বাপু! আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিজেই টিপল নম্বরগুলি বেশ নিপুন হাতে। নিজেই মিস কল দিল নিজের মোবাইলে। আমি তখনও ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছি মাথা নিচু করে। সিগারেটের ছ্যাঁকায় মুখ বেঁকে গেল।
- ওটা শেষ হয়ে গেছে, কাউন্টার পার্ট নেই আর! ফোন করলে রিসিভ করো কিন্তু। মুচকি হেসে লাল শাড়ি উড়িয়ে চলে গেলেন। আস্কারা, মাশকারা সব পেয়েছি, আমার আবার সেই চিকেন টাইপ স্বপ্ন দেখা শুরু। জবাই এবার হবই আমি নিশ্চিত।
মেয়েদের সামনে দাঁড়ালে পুরুষকূল মুরগী টাইপ বিহেভ করে। তবে একটু আস্কারা পেলে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞাপনও বেমালুম ভুলে যায়। পুরুষের এই হল সবচেয়ে বড় রোগ। হাইব্রিড দিল আমার, যায় কোথায়! কি দারুণ মিলিঝুলি রসায়ন, আহা, কামিনী, বর্ণালী আর আমার হাইব্রিড মুরগী হৃদয়ের!


এরপর থেকে আবার কামিনী ফুলের প্রেম। কিচ্ছু ভালো লাগেনা। মা বলেন, চোখটা দেখা তো একবার। খুব বেশীই পিটপিট করছে আজকাল। বৌদি বলে, এতো ধকল সইবে কেমন করে এইটুকু বুকে। মানে আমার টেনেটুনে চব্বিশ ইঞ্চির বুক। কিচ্ছু বাদ দিইনি সেবনে। ছাগলের বড়ি দুধ সহযোগে আমার এক দাদার পরামর্শে। সকালে উঠে বাদাম, ভেজা ছোলা, লিভোসিন কিচ্ছু বাদ দিইনি। মধ্যে জগিংও শুরু করেছিলাম। কিন্তু এক সকালে ঘুম চোখে উঠতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে ঠ্যাঙ ভেঙ্গেছি। তিনমাস বিছানায়। যখন ফিরলাম তখন প্রথমেই রিফিউজ করলেন আমার চীফ এডিটর। আরেকটু জিরিয়ে নাও, স্বাস্থ্যটার যা অবস্থা। মুচকি হেসে এন্ট্রি নিয়েছে বিল্লু সুন্দরী। মানে আমার সিনিয়ারের গার্ল ফ্রেন্ড। বেশ দেখতে, আবার চোখ পিটপিট। এতো কৃচ্ছ্রসাধন করেও গায়ে এক চড়ুইয়ের মাংস লাগাতে পারিনি। স্নানে গেলেও জামা খুলিনা। আয়না যদি লজ্জা পায়! শুনেছি আয়না নাকি স্ত্রীজাতীয়।


হিসেব করে দেখলাম আমার কামিনী গাছের বয়েস এখন একুশ। একুশের স্বাধীনতায় হাসছে তার রুপ। তাই বেড়েছে আজকাল বিদ্রুপ। বর্ষার সময়টায় রূপে গন্ধে ওয়াইল্ড স্টোনের বিজ্ঞাপন। মোটা পাতায়ও ঢাকেনা শরীরের আনাচকানাচ।
সবুজ শাড়ীতে বর্ণালী আজ বসে আমার মুখোমুখি। বিয়েটা কবে করলো কে জানে! সাজানো সংসার। পরিপাটি সুখ। বৃষ্টি আড়াল করে রেখেছে দিনের আলো, বর্ষা দুপুরে একান্তে আমি আর আমার ক্লাস এইটের বর্ণালী।
লাইম জিনে চুমুক দিয়ে শরীরটা কেমন জানি করছে। দুজনেই চুপচাপ। সামনে পাঁঠার কুচি কুচি হৃদয়ের টুকরো গাঁথা টুথ পিকে, সাদা ডিশে।
সেদিন কতটা মার খেয়েছিলে হারু স্যারের কাছে? খুব! আজ যদি আবার কেউ এভাবে মারে তোমায়?
এই রে, আবার কামিনীদণ্ড! এই যাত্রায় গণমৃত্যু নিশ্চিত, এসমস্ত কেস বহুবার দেখেছি। এখন এতো বছর পর প্রতিশোধ নেবে নাকি নিজের ঘরে ডেকে এনে!
উড়ে গেছে শরীরের সব ক্যামন ক্যামন ব্যাপার সেপার, ফুড়ুৎ করে। আমি এখন যাই বর্ণালী, থ্যাংক্স।
ওইটুকুই শুধু বলতে পেরেছিলাম মনে আছে। শেষ বাক্য জবাই হওয়ার আগে।


যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন দেখলাম, হাল্কা সবুজ বিছানায়, কামিনীর শরীরে লেপ্টে আছি আমি। আমার পিঠে হাত রেখেছে বর্ণালী। অজস্র চুমুতে আমার পিঠ আজ সত্যিই সুস্থ। আমার ঠোঁটে বর্ণালীর নিভৃত অত্যাচার।
কামিনী ফুলের এই মৃত্যুই ছিল আমার জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত। সেই প্রথম নিজেকে দেখলাম, প্রকৃতি কোন খেয়ালেই আমার সাথে কোন প্রতারণা করেননি বিশ্বাস করলাম। আমি উন্মুক্ত এক বিহঙ্গ, মিশে আছি আমার প্রথম প্রেম বর্ণালীর শরীরে। জানি শুধু বেঁচে আছি আমি আর আমার বর্ণালী।
মরেই সুখ এই বর্ষায়। ফুলের গন্ধ নিয়ে তো যাওয়াই যায় স্বর্গ অথবা নরকে। বর্ষাস্নান শেষে আমি আজ পুরুষ হলাম। এমন মরণ আমি মরতে রাজি আছি বারবার, তোমার খোলা হাওয়ায় বর্ণালী।
আমার চিকেন হৃদয় আজ পুরুষ হলো। বলেছিলাম না আস্কারা পেলেই পুরুষ ভুলে যায় জন্মনিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞাপন।
ফিরে আসার সময় ও আমায় শুধু বলল, কিছু যদি হয়ে যায়!
- হতে দাও।
- তারপর! কি বলব ওকে!
বলবে, আমিই দায়ী ছিলাম।


এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। কষ্ট হতো কিন্তু ফোন করিনি ওকে আর কোনদিন। অপেক্ষা করছিলাম। হটাৎ একদিন সক্কাল বেলায় একটি ফোন আসে শহরের একটি পরিচিত নার্সিং হোম থেকে। রিসেপশান থেকে কেউ একজন বললেন, গুড মর্নিং মিস্টার সাঁই, মিসেস রায় অন লাইন... প্লিজ হোল্ড অন। ঘাবড়ে গিয়েছি। ভুল করে আবার কেউ আমায় স্বামীটামি বানিয়ে দিল না তো! আরে রং নাম্বার... শুনুন আমি এখনও অবিবাহিত, মা পাত্রী দেখছেন সকালে, বৌদি দুপুরে, আমি মধ্যরাতে দেখছি অনলাইনে। চন্দ্র, কেতু, মঙ্গল মিলছে না... বলতে বলতেই
ওপার থেকে মিষ্টি আওয়াজ, হ্যালো! এই তোমার মেয়ে হয়েছে।
এই রে এই সাত সক্কাল বেলায় ইয়ার্কি, আমি এখনও বিয়েই করলাম না, আর হবেও না কস্মিনকালে, কোনদিনই। আমার আবার মেয়ে! আপনি বোধহয় ভুল করছেন ম্যাডাম। অন্য কোথাও বাবা খুঁজুন মিসেস রায়, প্লিজ।
ওপার থেকে আবার সেই শান্ত মিষ্টি হাসির গলা, সাঁই আমাদের প্রথম সন্তান। মেয়ে হয়েছে তোমার মতোই। তবে চোখ গুলি বড্ড পিটপিট করছে।
এই কি রে... কি শান্ত গলায় মহিলা বলেই যাচ্ছে শুধু, মেয়ে হয়েছে মানে, আমার মতো... মানে!
এইবার আমি দেশি মুরগীর মতো কক্কক... ক্ক... একবারই করলাম। বিশ্বাস করুন আপনি ভুল করছেন কোথাও। আমি আপনার মেয়ে, মা বউ কেউ না। প্লিজ...
- কি সাঙ্ঘাতিক আমার কথা শুনলই না, কি শান্ত ভাবে বলে গেল, জানো ও দারুণ খুশী। তুমি আসবে না! দেখবে না তোমার মেয়েকে! সিগারেটটা শেষ করে চলে এসো জলদি। আমি অপেক্ষা করছি...। লাইন হ্যাস বিন ডিস্কানেক্টেড। কেটে গেল লাইনটা!
সক্কাল বেলায় টয়লেটে গেলেই আমি আর্কিমিডিস টাইপ কেউ হয়ে যাই। বুঝলাম, সেই হারু স্যারের কেস!
এই প্রথম আমার কামিনী ফুলেদের আমি ছিঁড়লাম। এতদিন শুধু ঝরে পড়তে দেখেছি। একথোকা কামিনী হাতে নিয়ে ছুটলাম নার্সিং হোমে।
- তোমার জন্য বর্ণালী।
-এই নাও তোমার জন্য। দুদিনের নরম শিশু আমার কোলে তুলে দিল বর্ণালী, আমি ভয় পাচ্ছিলাম। এতো নরম আর মিষ্টি যারা তাদের কি স্পর্শও করা যায়!
- বিনিময়!
- নাহ, আমায় দিলাম।
কি তুলতুলে! হাত বাড়িয়ে নিলাম। টের পাচ্ছিলাম আমার চোখ আজও সাবালক হয়নি, যেকোন সময় ঝড়ে পরবে।
- ওর নাম রেখেছি কামিনী... পছন্দ হলো নামটা! তোমার প্রিয় ফুলের নাম।
খুশি খুশি মুখ করে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার রায়। বর্ণালীর স্বামী। আমার দিকে তাকালেন শুধু একবার। সৌজন্যে, মুচকি হাসলেন একটু।
- গুছিয়ে নাও এবার, তোমার ডিসচার্জ হয়ে গেছে বর্ণা, সবাই অপেক্ষা করছে তোমাদের।
ইশ আজ যদি আবার হারু স্যার আমায় বেত্রাঘাত করতেন আরেকবার! হয়তো আজীবন বেঁচে থাকতে পারতাম। এভাবেও কেউ কিছু দেয়!











অল্প-স্বল্প গল্প-গাথা




মৌ দাশগুপ্তা

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সিনহা বাড়ীর মহিলা মহলে সাজ সাজ রব, অথচ দেখতে গেলে ব্যাপারটা এমন কিছু আহামরি নয়। প্রতি মাঘী পূর্ণিমায় এ বাড়ীর আরাধ্যা কমলা কিশোরীর পূজো হয়। এ বছর একে মাঘী পূর্ণিমা বৃহস্পতিবারে পড়েছে, তারওপর বাড়ীর গিন্নী সুশীলা দেবীর বিচ্ছিরি ধরনের ডায়াবেটিস ধরা পড়ায় নতুন বউ রাই এর ওপর পুরো ঝঞ্ঝাটটা এসে পড়েছে। সে বেচারা এমনিতেই একটু ধীর স্বভাবের , তায় মেজাজী শাশুড়ীকে একটু ভয়ই পায়, কখন কোন কাজে কি খুঁত ধরা পড়বে আর মিষ্টি কথার হূল খেতে হবে, সেটা ভেবেই একটু তফাত থাকে, আজ আর বেচারীর রেহাই নেই।






বাড়ীর লোকসংখ্যা যে অনেক তা নয়, গৃহকর্তা কেশব বাবু, বাড়ীর গিন্নী সুশীলাদেবী, তাঁদের ছেলে কৃষ্ণমোহন, ছেলে-বৌ রাই, কলেজ পড়ুয়া দুই মেয়ে কান্তা আর করুণা, কেশব বাবুর দূর সম্পর্কের বিধবা ভাগ্নে-বৌ বনলক্ষ্মী (বাড়ীর বিনা পয়সার রাঁধুনী), আর সব সময়ের কাজের লোক সাবিত্রী, কূল্যে আটজন। বাড়ীর পুরুষমানুষরা অত ভক্তিমান নন, দুজনেই যথানিয়মে এবং যথাসময়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন অতএব মহিলা মহল সোৎসাহে ভীড় জমিয়েছেন দোতলার ঠাকুরঘরে। আজ ঘরের হেঁসেলে নিত্যকালীন ভাতডাল রান্নার পাট নেই, ছেলেরা পূজোয় ভাগ নেবেন না, তবে ঘরেও ভাত জোটেনি তাই আজ অফিস ক্যান্টিনেই খেয়ে নেবেন। ঠাকুরঘরের পাশের একফালি ছাদটাই ধুয়ে মুছে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে,নতুন তোলা উনুনে পূজোর হাঁড়ি পাতিলে ভোগ বানানোর প্রস্তুতি চলছে।





রান্নাবান্নার দায়িত্ব রোজকার মত বনলক্ষ্মীর ওপর, রাই-র ওপর ঠাকুরঘরের কাজ,যে যার কাজে লেগে পড়েছে। সাবিত্রীর রোজকার ঝাঁটপাট,মোছামুছি,ধোয়াধুয়ি চলছে, বাড়ীর বড় মেয়ে কান্তার সাথে সকালেই তর মায়ের একচোট লড়াই হয়ে গেছে, আজ বাড়ীর পূজোর অজুহাতে সুশীলাদেবী কান্তাকে ঘরবন্দী করেছেন, এদিকে ওর বন্ধু, (ইয়ে, মানে বিশেষ ছেলেবন্ধু) মাধব আজ একটু বিশেষ ধরনের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে, এখন কান্তা কি করে? মাকে বলতে পারছে না মাধবের কথা, আর মাধব বুঝছে না বাড়ীর অসুবিধার কথা। তাই দুজনের উপর রাগ করে দোতলাতেই নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে । ছোট মেয়ে করুণার ঠাকুর দেবতায় অত ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই, নেহাত কলেজে সেমিষ্টার পরীক্ষা চলছে, কলেজ বা বন্ধুর বাড়ী গিয়ে বসে থাকতে পারছে না, আর দিদির সাথে মায়ের ঝামেলার বহরটাও দেখে নিয়েছে,তাই কানে হেডফোন গুঁজে বইপড়ার ভান করছে। সুশীলাদেবী ঠাকুরঘর আর রান্নার জায়গার মাঝে চেয়ার পেতে বসে সবদিকে নজর রাখার মহান কাজটি করছেন।






কথায় বলে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, এখানে সেটা একটু পাল্টে কর্ত্রীর ইচ্ছেয় হয়ে থাকে। পূর্ণিমা লাগবে সন্ধ্যা নাগাদ, ততক্ষণ অবধি সব নির্জলা উপোষ। না খেয়ে থাকলে একদিনে কেউ চোখে অন্ধকার দেখে না, বা অসুস্থ হয়ে পড়ে না সেটা ঠিক-ই, খালি পেটেয় ছুঁচোর দঙ্গল ডন-বৈঠকি মারে। তবে নিজের থেকে মন স্থির না করলে, মানে, বাধ্য হয়ে, বা অন্যের কথামত উপোষ করে আছি ভাবলেও খিদে তেষ্টা বুঝি বা মানুষকে একটু বেশীই কাবু করে তোলে।এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।সবাই যে যার বরাদ্দ কাজ মুখ বুঁজে করে যাচ্ছে বটে, অন্যদিকে ইন্দ্রিয়গুলো কিন্তু পূজোর পাকশালাতেই ঘোরঘুরি করছে। সাবিত্রী আবার সুশীলাদেবীর খাস লোক। ঘরের সবার গোপন এবং নির্ভরযোগ্য খবরটি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছানোটাও ওর কাজের মধ্যেই পড়ে। বয়স খুব বেশী না হলেও বোঝে খুব বেশী,তাই সময় থাকতেই উঁচু ডালে মই বেঁধে রেখেছে। বাড়ীতে রান্নার পাট নেই, কেউ যাতে লুকিয়ে খাবার খেয়ে উপোষ ভেঙ্গে বাড়ীর অকল্যাণ না করতে পারে তার জন্য গিন্নী স্বয়ং রান্নাঘরে, ভাঁড়ারঘরে,তালা দিয়ে চাবি আঁচলে বেঁধে রেখেছেন।সকালে যেখানে কর্তামশাই দাদাবাবু না খেয়ে বেরিয়েছেন সেখানে কে আর হেঁচিপেচি সাবির জন্য খাবার কোলে বসে আছে? অথচ সাবির মত কাজ সকাল থেকে কে করছে? সেই কোন কনকনে ঠান্ডা ভোর রাত থেকে গোটা দোতলা বাড়ী ঝাঁটপাট,মোছামুছি, এতগুলো লোকের গত রাতের এটোঁ বাসন ধোয়াধুয়ি, কাপড় কাচা চলছে, হাত-পা ভেরে গেছে, কিন্তু পেটে দানাটি অবধি নেই। গিন্নীমাটির রোগজনিত কারণে খাই খাই ভাবটা ইদানীং খুব বেড়েছে, আসল খিদে কি চোখের খিদে বলা মুশকিল , ডাক্তারের কড়া নির্দেশে খাবারের পরিমানতো অনেক কমেছেই, তার সাথে না খেতে পারার তালিকায় অধিকাংশ প্রিয় খাবারের অন্ত্রভুক্তি ঘটায় মনোকষ্টটাও বেড়েছে বই কমেনি। আজ হয়ত তাই সেগুলোই ভোগে উৎসর্গ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেগুলো এখন ওনার নাগলের বাইরে বললেই হয়। কমলাকিশোরীর পরিতৃপ্তির থেকেও কিছুটা নিজের রসনাতৃপ্তির ব্যাপারটাই বোধহয় অবচেতনে কাজ করেছে এদিকে লিস্টি বানিয়েছে যজ্ঞিবাড়ীর,কিন্তু কার যে লোভের পরিতৃপ্তি হচ্ছে দেবতার নামে, সে কি আর কারো জানতে বাকি আছে? । খিচূড়ী, লাবড়া, চরু, নারকোলের নাড়ু,তক্তি,মোয়া,মুড়কি,পুলি পিঠে, মুগতক্তি, রাঁধিয়ে একমনে ঘাড় গুঁজে সকাল থেকে ঘেমে নেয়ে বানিয়ে যাচ্ছে, আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘ্রাণে অর্ধভোজন তো হচ্ছেই সাথে মুখের ভিতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে যা জল কাটছে তাতে তেষ্টাটাও পাবে না বোধহয়।






গিন্নীমাটি অবশ্য গতর নেড়ে কাজটিওতো করেন না, হাঁটাচলাও তো ঘরের মধ্যেই, এ ঘর থেকে ওঘর। বেশী খেলে হজম হবে কি করে? শকুনির দৃষ্টি মেলে সক্কাল থেকে থানা গেড়েছে সামনে, যেন রাঁধতে রাঁধতে লক্ষী বউদিই আধা পেসাদ পেটে লুকিয়ে রাখবে! সবাইকে নিজের মত নিখাউন্তী ভাবছে ! এদিকে ঠাকুরকে দেবার আগে যে নিজেই চোখ দিয়ে গিলছে সে কি আর কেউ টের পাচ্ছে না? পূজো যাদের ঘরের, উপোষও বাপু তারাই করুক না, কি দরকার অন্যদের জোরজার করে নিয়ম মানানোর?



তারপরে ঐ লক্ষী বৌদি, নিজের বলতে সেরকম কেউ কোথাও নেই বলে, বলতে গেলে একরকম দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া পরার বিনিময়ে এখানে আছেন, বদলে সংসারের হেঁসেল সামলাচ্ছেন। তাতেও কথা তো আর কম শুনতে হয়না! কিন্তু এই যে এ বাড়ীতে ওনাকে ঠিক পরিবারের একজন বলে মানা হয়না । বরং মাঝে মধ্যে বোঝাই যায় যে ওনার জায়গাটা সাবিত্রীর থেকে খুব একটা আলাদা না, তাও তো সাবির না পোষালে অন্য বাড়ীতে কাজ নিয়ে বেরিয়ে যাবে, বনলক্ষ্মী তো সেটাও পারবেন না। অথচ বাড়ীর পূজোর বাহানায় এই শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভোর রাতে স্নান সেরে সারাটি দিন জল অবধি না খেয়ে সেই যে পাকশাল সামলাচ্ছেন তাতে কারো কিন্তু সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকু অবধি নেই। তা ওনার তো কারণে অকারণে ব্রত পার্বন,সাত-সতেরো, তার ওপর ছোঁয়াছুয়ি, মানামানিটাও লোক দেখিয়ে একটু বেশী করতে হয়, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী সবই মানেন, উপোষ করাটা ওনার কাছে হাঁচি কাশির মত নিত্যি ব্যাপার ।অথচ সারাদিন তো রান্নাঘর আর ভাঁড়ারঘরেই খুচখাচ চলে, তা মুখ কি আর চলে না? খুব চলে। নয়তো অত টুসটুসে চেহরাটা থাকে কি করে? আজও সব নিয়ে যে ভাবে সবার দিকে পিছু ফিরে মুখ গুঁজে বসেছে দু এক গাল মুখ চালালেও কেউ টেরটি পাবেনা।

বড়দি তো সাতসকালেই মায়ের সাথে ঝগড়া করে গোঁসাঘরে খিল দিয়েছে, ও প্রায়ই হয়।বাপের আদুরী কিনা, যতক্ষন না বাপে এসে “বাবা বাছা” বলে ডাকাডাকি করবে, ততক্ষন দরজা খুলবে না, আজকাল তাই বড়দি ঘরে দোর দিলে কর্তাবাবু না ফেরা অবধি কেউ ডাকেও না।আর রাগ হলে বুঝি ওদের খিদে টিদেও পায় না।ওদের আর কি? খিদের জ্বালা জিনিষটা কোনদিন ভুগতে হয় নি কিনা! এই যেমন ছোড়দি, খেলে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে সেধে একবেলা খায়, ভাত রুটি খায়না, ভাজভুজি,মশলাদার খাবার, মিষ্টি এসব কিচ্ছু খায় না। সারাদিন তো ঐ লেবুর রস, টকদই, ফল, স্যালাডই খায়, সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে কারণ ছাড়া উপোষ।






দুই মেয়ের পর ঐ টিংটিং চেহারার কনে বৌটি, আলালের ঘরের দুলালী কিনা, রীতিমত খুঁটে টিপে ফেলে ছড়িয়ে ছাড়া খেতে পারেনা। না খাবার লিস্টিটাই এত বড় যে, কি খায় কে জানে,ডাল খেলে পেট ফাঁপে,ফল খেলে অ্যাসিড হয়,শাক দেখলে বমি আসে,মাটির নীচে হওয়া সব্জিতে অ্যালার্জি আছে।কত ঢং যে জানে। ঘনঘন পেটের প্রবলেমে ভোগে আর খাওয়া দাওয়া ছেড়ে চোখ উল্টে পড়ে থাকে।নেহাত বাপে ডাক্তার , তাই রক্ষে।নয়ত ঐ রক্ষাকালীর অসুখ সারাতেই সব ফতুর হয়ে যেত।
তা সাবির তো আর অত সুখের জীবন না,শখেরও না, রীতিমত গতর খাটিয়ে পেটের ভাত জোগাতে হয়।সাবিকে নিজের ভালোটা নিজেকেই বুঝতে হবে। কাজপাট সেরে গিন্নীমার পা টিপে দেবার আছিলায় বসে থাকতে হবে, ঐ দুই পথের কাঁটা নিজেদের এলাকা থেকে একটু সরলেই টুক করে হাত আর মুখের কাজটা সেরে নিতে হবে, এমনিতেও সকাল থেকে এতপদ রান্না হলে কি হবে, সাবিকে দিতে করো হাত সরবে না তখন সাবির ভাগে যত গুঁড়ো-গাড়া ফেলা-ছড়া জিনিষ!






ভাবনা চলে ভাবনার মত আর সময় চলে সময়ের মত, দুজনেই নিরন্তর বহমান কিন্তু একসঙ্গে যে গতিশীল তা নয়।সময়ে ছেদ পড়ে না, ভাবনায় পড়ে। পুরোহিত এসে পড়ায় সাবিকে চিন্তায় যতি দিতে হল। রাই,করুণা,পুরোহিতের সাথে ঠাকুরঘরে ঢুকলো, বনলক্ষ্মী সারাদিনের ক্লান্তি সরিয়ে নীচে গেল একটু গরম জলে স্নান সেরে সে অঞ্জলি দেবে, সাবির বাবা ত পূজো পাটে ভক্তি নেই।দুমুঠো পেটের ভাত জুটলেই হোল,তা পূজো শেষ হতে এখনও অনেক দেরী, সকালের উপোষী শরীর আর টানছে না অতএব সাবি গায়ে কাপড়টা টেনে গুড়িসুড়ি মেরে নীচের বৈঠকখানায় বসতে গেল, টিভি দেখতে , সুশীলা বোধহয় বড় মেয়েকে ডাকার বৃথা চেষ্টায় যাচ্ছিলেন, এমন সময় হঠাৎ বনলক্ষ্মীর আর্ত চিৎকার। জল গরম করতে গিয়ে বেখেয়ালে শাড়ীতে আগুন ধরে গেছে, বিপদের ওপর বিপদ,চিৎকার শুনে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে সুশীলা সেই যে আছাড় খেয়ে পড়েছেন আর উঠতে পারছেন না।এদিকে পূজো শুরু হয়ে গেছে, থামাতে গেলে অমঙ্গল। নেহাত কান্তা গাড়ী চালাতে জানে,গোঁসা ঘর থেকে বার হয়ে কান্তা তৎক্ষণাৎ মা,বোন,বনলক্ষ্মীকে নিয়ে কাছেই রাইয়ের বাবার নার্সিংহোমর দিকে রওনা দিল, রাই ও চললো সাথে, দু’জন আহতকে সামলাতে দুটো লোক তো লাগবে, নাকি? সপুত্র কেশব বাবুকেও খবর দেওয়া হোল।






যথাবিহিত পূজো-পাঠ, হোম-আহূতি সেরে পুরোহিত মশাই অঞ্জলি দেবার জন্য ডাকলেন যখন, তখন বাড়ীতে সাবি ছাড়ার কেউ নেই। খুব মন দিয়ে পুষ্পঞ্জলি দিল সাবি।“সবার মঙ্গল কোর ঠাকুর, সবার মনের ইচ্ছা পূর্ণ কোর।“







সময়






ডঃ কাকলী মুখোপাধ্যায়






নর্দমার ধারেই সেলুনটি। স্কুলে মেয়েদের ভীড়ে উকুন এসেছে ছোট্ট মানুর মাথা ভরে। মা’তো রেগে মেগে আগুন। ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দিল সেলুনে । মাথা ন্যাড়া করতেই হবে। নাপিত ধনঞ্জয়ের সাথে মানুর বিশেষ সখ্যতা। অন্য সাহেবদের বাচ্চাদের মত মানুর মধ্যে হাম্বড়া ভাবটা একেবারেই নেই বললেই চলে। খুব সহজ সাধা সিধে এই মেয়েটি। এসেই খলবল করে কথা বলতে শুরু করে--এই যেমন আয়নাটা কোথা থেকে কিনেছো ? চেয়ারটা এরকম ঘোরে কেন ? তোমার মাথায় চুল নাই কেন? চুল কাটলে আবার কবে চুল উঠবে এইরকম নানান কথা । বড্ড মিষ্টি মেয়েটি। আজকে বেশ মন খারাপ নিয়ে মানু এসেছে । পিঠ পর্যন্ত ঘন কালো চুল গুলো উকুন হওয়ার অপরাধে কেটে ফেলতে হবে। স্কুলে গেলেই সবাই টাক বেল বলে খ্যাপাবে। ধনন্জয় মানুর মনের কথা বুঝতে পারে। বলে দিদিমণি চিন্তা করোনা এমন চাঁছ দেব দেখবে তিন দিনেই চুল গজিয়ে যাবে। কিছুটা আস্বস্ত হয়ে চুল কাটতে বসে গেল মানু। বাড়ির ছাদে চুল শুকোতে শুকোতে তিরিশ বছর আগের ধনন্জয় দার কথা মনে পড় গেল মানুর। ঐ সামান্য নাপিত তারও কত স্নেহ কুড়িয়েছে মানু অথবা মনতোষের বাবা সেই বৃদ্ধ মাছওয়ালা। তার কথা ভাবলে আজও চোখে জল আসে মানুর। মনতোষ মানুদের বাড়িতে কাজ করতো ও মানুর সমবয়সী ছিল। কাজ শেষে মনতোষ আর মানু খেলায় মশগুল হয়ে উঠতো। কখনও মনতোষ গাইতো আর মানু নাচতো। একবার মানুর পা মচকে গেলে মনতোষের সেকী কান্না। আবার মনতোষের জ্বর, মানু চুপিচুপি ঘুম থেকে উঠে মার ঘর থেকে কমলালেবু চুরি করে মনতোষকে দিয়ে এসেছিল। মনতোষের বাবা গুড়ো, মাছ বিক্রী করতো। মানুদের বাসায় ছেলেকে দেখতেও আসতো মাছও বিক্রি করে যেত। ছেলেকে ভালোবাসে বলে মানুকে বিশেষ স্নেহ করতো বৃদ্ধ।






মহল্লায় বাপের আদুরে মেয়ে হিসেবে মানুর বিশেষ পরিচিতি ছিল। তাই মানুর অনেক আবদার অনেকেই নীরবে হজম করতো। অনেকদিন হল মনতোষের বাবা আর আসেনা। মনতোষ মানুদের বাড়ী ছেড়েছে প্রায় দশ বছর। মানুর বাবা মারা যাবার এক মাস পর হঠাৎ একদিন মাছ নিয়ে মনতোষের বাবার আগমন। মানুকে দেখে গদগদ গলায় বললে মানু কেমন আছ সোনা। “এদিকে আসা হয়না, তাই বলে মনে করোনা যে তোমাকে ভুলে গেছি। মাছ নিবা”? মানু সম্মতি জানায়। “কয় ভাগ দিব? দুই না তিন? বাবা কোথায়” ? “বাবাতো নেই”। মানুর গলাটা কেঁপে যায়। বজ্রাহতের মত তাকায় বৃদ্ধ। ডালার ওপরে যত মাছ ছিল মানুর খোলুইএ ঢেলে দিয়ে ধূতির খুঁটে চোখ মোছে বৃদ্ধ। আহারে বাপের আদরের মেয়ে আজ বাপ ছাড়া। “নাও সোনা এই সব মাছ তোমার, পয়সা লাগবেনা। আমিতো তোমার বাবার মতই”, বলে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকলো বৃদ্ধ। মানুর চোখেও জলের বান ডেকেছিল আজও চোখ জলে ভরে উঠলো। মনে পড়ে গেল গরফুলের কথা। মেথর গরফুল মদ খেয়ে টাল হয়ে মহল্লার রাস্তা ঝাড়ু দিত। বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখলেই তেড়ে আসতো। একদিন গরফুলের তাড়া খেয়ে মানু ছুটতে ছুটতে বাড়ির বাথরুমে ঢুকে মালিনী ঝিকে জড়িয়ে ধরেছিল। পরে বড় হয়ে জেনেছিল নিঃসন্তান গরফুলের এ ছিল এক মজার খেলা। বাবা মারা যাবার পরদিন গরফুল দুটো কলা নিয়ে হাজির। কাঁদতে কাঁদতে বললো “মাইজী বাবু নাই, তুমাক আদর করবে কে”? আবার চোখ ভিজে উঠলো মানুর ।


জীবন ভর মানুষের ভালোবাসাকেই মানু দাম দিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ কোথায় ভালোবাসা ? সামান্য সহানুভূতির সুরেও অনেক দিন কেউ মানুর সাথে কথা বলেনা। সিজারিয়ান অপারেশন করে মানুর মৃত সন্তান বের করে আনে ডাক্তার। সমীর খুব রূঢ় ভাবে বলে “তোমার দোষেই এটা হল”। কিছুদিন পর কোন এক বাসায় বেড়াতে গিয়ে একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে খুব আদর করছিল মানু সমীর মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল “যোগ্যতা থাকলে তো নিজের বাচ্চাকেই আদর করতে”। অপারেশনের ঘা শুকোতে না শুকোতেই রান্না ঘরে চুলার পাড়ে বসতে হয় মানুর। দশ বারো জনের রান্না করে হাসি মুখে পরিবেশন করার পরেও শুনতে হয়েছে “সোয়ামণ পাপ না করলে পেটের মধ্যে বাচ্চা মরেনা”।






সোয়ামণ পাপের খোঁজ আজও মানু পায়নি। অনেক হাতড়ে সোয়ামণ পাপের ফিরিস্তি পায়নি মানু। মাঝে মধ্যেই জুয়ায় হেরে এসে সমীর ধাক্কা দিয়ে মানুকে ঘর থেকে বের করে দেয়,অনেক দিনই মানুর রাত কাটে বাড়ির ছাদে। একদিন হঠাৎ ফোন করে মিঠু। মানুর স্কুল কলেজের বন্ধু,“কেমন আছিস মানু ? তপুদার কাছ থেকে তোর মোবাইল নাম্বারটা পেলাম”। অনেক কথা মনে পড়ে যায় মানুর, বলে “বিশাল সংসার সামলাচ্ছিস বল? বড় ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে, মেয়ে ফাইভে, তাও শুনেছি দাদার কাছ থেকে। তোর সেই ঘণ কোঁকড়া চুল গুলো আছেতো? মনে আছে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছিলাম তোর চুলে তারপর ছিঁড়ে কেটে বের করতে হয়েছিল”। হঠাৎ ঘরে ঢুকে সমীর। হ্যাঁচকা টান দিয়ে মানুর হাত থেকে ফোন নিয়ে নেয়। ‘কে আপনি’ ? ‘আরে সমীর দা নাকি। আমি মিঠু। মানুর সাথে আমার আদ্যি কালের প্রেম। হা হা হা’। সমীর বেশ মিষ্টি স্বরে কথা বলে মিঠুর সাথে। ফোন রেখেই প্রচণ্ড জোড়ে থাপ্পর মারে মানুর গালে। মানু ঘুরে পড়ে যায়। তার অপরাধটা কি মানু বুঝতে পারেনা। সমীর খিস্তি করতে থাকে। বিরবির করে বলে “কত নাঙ যে লাগে মাগীদের”। সমীর চলে যায়। বারে জুয়ার আড্ডা বসবে। বড় ছেলে তন্ময় এসে পাশে বসে। ক্ষোভে দুঃখে কাঁদছিল মানু। ছেলে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নীরবে উঠে যায়। দিন দিন সমীরের ব্যবহার ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। জুয়া খেলে বাড়ি ঘর সব বেচে দিয়েছে। ব্যাঙ্কেও টাকা নেই। ব্যবসা পাতি লাটে উঠেছে। মানুর চাকরীর টাকা দিয়ে ছেলে মেয়ের লেখাপড়া,খাওয়া দাওয়ার খরচ মেটে। বাদ বাকি নির্ভর করে জুয়ার দানে জেতার ওপর। হারলেই সেদিন মানুর উপর নির্যাতন চলে। যেদিন জিতে এসে মানুর পা ধরে মাফ চায়। সমীরকে ঘেন্না ভক্তি কোনাটাই মানু করতে পারেনা। খালি দিন গোনে কবে মেয়েটিকে পাত্রস্থ করবে আর ছেলেটি পাশ করে একটা চাকরী নিবে আর তারপর মানু বেরিয়ে পড়বে অবাধ জ্যোৎস্নার, খুঁজবে মনতোষকে,মিঠুকে, ঝালমুড়িওয়ালাকে,অথবা সেই কেষ্টাকে। আরও আরও কত মানুষ আছে যাদের খুঁজতে হবে পেতে হবে মানুকে। সেই রিক্সাআলার বাড়িতে যেতে হবে-মানুর এক ছাত্রী ছিল অমি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো মানু। একদিন রিক্সায় ঘুরতে ঘুরতে অমির মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হল । যেই বলা সেই কাজ। মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়লো দুজন রিক্সা বাইরে দাঁড় করিয়ে। মানু বেশ কয়েকটা দামী সন্দেশ কাগজে মুড়ে রিক্সাঅলাকে দিল। ওমা রিক্সাআলা কোথাথেকে মিষ্টি পান কিনে এনে মানুকে দিল। অমিতো হেসে বাঁচেনা। রিক্সা থেকে নেমে মানু বেশ জমিদারি চালে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট রিক্সাআলাকে ধরিয়ে দিল। রিক্সা আলা বলল,”আফা আপনি যা দিলেন তা আমার পাওনার থেকে অনেক বেশী কিন্তু আমি খুশি হইছি আপনার সন্দেশ কয়খানের জন্য। আমি যহন বাড়িত যামু আমার পোলাপান খুশিতে বাকবাকুম হইয়া সন্দেশ কয়খান খাইবো”। মানু পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করলো। ওর খালি মনে হল বাচ্চাগুলোকে হাড়ি ভরা সন্দেশ কেন কিনে দিলামনা। যাবার সময় রিক্সাআলা তার ঠিকানাটা দিয়ে গিয়েছিল,বলেছিল 'আফা একদিন গিয়া বালবাচ্চাদের দেইখা দোয়া দিয়া আইয়েন'। মানু যাবে সেই আলাদিনের দৈত্যের মত রাশি রাশি খাবার নিয়ে। অথবা অম্বিকা পুরে গায়েন হাজেরাবিবির সন্তানরা কেমন আছে তা দেখতে চলে যাবে। হাজেরা বিবি মানুকে মা ডেকেছিলেন। একদিন এক দুঃস্বপ্ন দেখে লাঠি ভর দিয়ে মানুর বাসায় এসে হাজির। দোয়া পড়ে ফু দিয়েছিলেন মানুর গায়ে। আবার চোখে জল আসলো মানুর। মানুর ভাসুরের মেয়ে জলিকে ছোট বেলা থেকে কোলে পিঠে বড় করেছে মানু। ওর পড়া লেখা ,বিয়ে সংসার সব কিছুই মানুর করে দেয়া। একবার বাড়িতে চুরি হল মানু বুঝতে পারে এ জলির মায়ের কাজ। জলি এবং জলির মা দোষ ঢাকবার জন্য অন্যায় ভাবে দোষ চাপিয়ে দেয় অনাথ কাজের মেয়ে আলোর ওপর।






মানু তখন গলব্লাডার অপারেশন করে বিছানায় শয্যাশায়ী। গলস্টোন এতই বড় হয়েছিল যে ডাক্তাররা ক্যানসার হবার আশঙ্কা করছিলেন। জলি যখন দেখলো কাকী কিছুতেই তাদের পক্ষহয়ে কথা বলছেননা ঘরে ঢুকে বিছানায় শয্যাশায়ী মানুকে লক্ষ করে বললো ‘আপনি আমার মাকে চোর বানালেন, আপনি মরলেও আপনাকে দেখতে আসবোনা’। মানু তাকিয়ে থাকলো স্তব্ধ হয়ে,এ কে কথা বলছে? যার পরীক্ষার ফি ভরার জন্য মানু দুপুরে না খেয়ে ছাত্র পড়িয়েছে? যার সংসারের প্রতিটি জিনিস মানুর দেয়া? মাত্র কয়েকদিন আগে যার বাচ্চা হবার সময় হাসপাতালের বিল চড়াসুদে টাকা ধার করে ভরেছে মানু? এই সেই জলি? এই মানুর প্রাপ্তি? মানু ঠিক চলে যাবে। জ্যোস্নায় খোলা মাঠের বুকে। হা করে জ্যোৎস্না সোমরস পান করবে। ওর সাদা চুল গুলোতে জ্যোস্নার মেয়েরা এসে হেসে মিশে যাবে। মিঠুর ঘাড়ে হাত রেখে বসে বলবে জীবনের সাত কাহন। হঠাৎ বৃষ্টি এল, মানু শুকনো কাপড় গুলো নিয়ে দ্রুতবেগে নীচে নেমে আসলো। দেখলো সমীর অনেক বাজার করে নিয়ে এসেছে। জুয়ায় জিতলে লোকটা মহাত্মা হয়ে ওঠে। রূপ বদলাতে এক সেকেণ্ডও সময় লাগেনা। মানু কৃত্রিম হাসি হেসে তাকায় সমীরের দিকে। মানুর চোখে মুখে উপর্যুপুরি চুমা দিয়ে বলে এরকম জিতলে মাইরি বলছি তোমাকে চীনে ঘুরতে নিয়ে যাব। একটু অবাক হয় মানু,ভোলেনি তাহলে! সেই প্রথম জীবনের কথা। কোন এক সন্ধ্যায় সমীর গলা জড়িয়ে ধরে খুব আহ্লাদ করে মানু বলেছিল ‘আমাকে চীনের পাথুরে ফুলের পাহাড় দেখতে নিয়ে যাবে’? বিস্ময়ে বিহ্বল মানুর চোখ দিয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়ে। ভেজা গলায় মানু বলে কি খাবে? কুমড়ার মোরব্বা,দুধকদু, চিতল মাছের কোপ্তা আর? সমীর উচ্ছসিত হয়ে ছেলে মেয়ের গাল টিপে দেয়। ছেলে মুখ বেঁকিয়ে মাথা নিচু করে ঘরে চলে যয়। মানু মেহেদী বাটা নিয়ে এসে সমীরের চুলে লাগাতে থাকে। ভালোবাসে বলে নয় এই সেবা করার স্বভাব মানুর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। অনেকবার সমীরের মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মানু কিন্তু বাচ্চাদেরকে লোকে বাপ তুলে কথা বলবে এই ভেবে ডাক্তারকেও মিথ্যা কথা বলেছে মানু। অনেক সময় রাতে সমীর অত্যাচার শুরু করলে বাসার সবার অগোচরে ছাদে চলে গেছে মানু। সারারাত ছাদে কাটিয়ে দিয়েছে বাবার স্নেহমাখা স্মৃতি গুলো মনে করে। সমীর খেয়ে দেয়ে বের হয়ে গেল। আর কত বছর লাগবে সব ঠিক হতে?






অন্ধকারে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মানু। সমীর যাচ্ছে, লাইটপোস্টের আলোতে একঝলক দেখতে পেল ওকে। ছেলেটা গতকাল একটা ইন্টারভিউ দিয়েছে চাকরীটা পেলেই একদিন মিঠুকে নিমন্ত্রণ করবে। সকালে বেশ দেরী করে ঘুম ভাঙে মানুর। বারোটার দিকে মাতাল হয়ে টলতে টলতে বাড়ী ফেরে সমীর। হাসতে হাসতে বলে দাদা ফোন দিয়েছিল তোমার একটা দোস্ত ছিলনা ওই যে টিচার মিঠু গতকাল ব্রেইন স্ট্রোকে মারা গেছে। শালা হতভাগা নিরামিষ! মদ ছুঁলোনা, মাগী ছুলোন্‌ জুয়ো খেললোনা, তবুও কেমন অকালে পটল তুললো। তাইতো বলি বাবা যতদিন বাঁচ ফূর্তি করে বাঁচ। হয়তো আর কেউই থাকবেনা। মনতোষ রিক্সাআলা কেউ না। মানু নিরবে ছাদে চলে যায়। মাঘী পূর্ণিমা। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। মানু তাকিয়ে থাকে।