গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

২৪তম সংখ্যা - ৪টি গল্প (১( 'তলিয়ে যাবার গল্প' / ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়, (২)'আমাদের পাঠশালা'/অর্ধেন্দু শেখর গোস্বামী (৩)'শুধু তোমারই জন্য' / সিদ্ধার্থ শর্মা (৪) 'আগমনী' / আনোয়ার হুশেন



ফা ল্গু নী মু খো পা ধ্যা য়

আমি

আমি এ গল্পের কেউ নই , না গল্পের চরিত্র না গল্পে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার সাক্ষী । তবু আমাকে ছাড়া গল্পটা শেষ হবেনা । আমি ওদের দুজনকেই চিনতাম, দুজন মানে সুদীপ্ত আর মিতালি । মিতালির সঙ্গে আমার দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা ছিল,বয়সেও কিছুটা ছোট ছিল । আমার ছেলেবেলাটা কেটেছিল বর্ধমানের এক গন্ডগ্রামে । আমি আর সুদীপ্ত একই স্কুলে পড়তাম,সুদীপ্তর ডাকনাম ছিল বুবুন, মিতালি বুবুনদা বলেই ডাকতো । কলেজেও দুজনে একসঙ্গে,আমি আর সুদীপ্ত । তারপর যা হয়,মামার বাড়ি থেকে আমি আর লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে পারলামনা । গ্রাজুয়েশনের পর একটা প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টারি নিয়ে আসানশোলে চলে গেলাম । ছেলেবেলয়, স্কুলে পড়তাম তখন , অনেকগুলো বছর কেটেছিল আমাদের একসঙ্গে । পেয়ারা চুরিকরে পুকুর পাড়ে বসে খাওয়া , ছোটখাট বদমায়েসি করা এইসব । খাওয়াদাওয়া সেরে দুপুর বেলা মিতালি আর সুদীপ্ত চলে আসতো আমাদের বাড়ি । আমি কবিতা পড়তাম মিতালি শুনতো আর সুদীপ্তটা ঘুমোত,ওর এসবে মন থাকতনা । সুদীপ্ত আসতো মিতালির টানে – এটা পরে বুঝেছিলাম । সুদীপ্ত লেখাপড়ায় আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিল । গ্রাজুয়েশনের পর আমি আর এগোলামনা , সম্ভব হলোনা। তারপর স্কুল মাষ্টারির চাকরী নিয়ে আসানশোলে চলে গেলাম, সুদীপ্ত, মিতালিদের সঙ্গে সম্পর্কটা ক্ষীণ হয়ে গেলো । সুদীপ্তর ওপরে ওঠার নেশা,আকাশ ছোয়ার আকাঙ্খা আমি আগেই টের পেয়েছিলাম । আমি বাধা দেবার কে ? কিন্তু মিতালির জন্য আমার মনে একটা অন্যরকম জায়গা তৈরি হয়েছিল । আমি মিতালিকে বলতাম শিরদাঁড়াটা সোজা রাখবি মিতালি । আসানশোলে চলে আসার পর সুদীপ্ত সঙ্গে প্রথম প্রথম চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল , পরে ও আর যোগাযোগ রাখতোনা, সাড়ে ছহাজার টাকা মাইনের প্রাইমা্রি স্কুলের শিক্ষককে চল্লিশ হাজারী এক্সিকিঊটিভের মনে রাখার কথাও নয় । একবার সুদীপ্ত লিখেছিল ‘ওসব মাস্টারি ফাস্টারি ছেড়ে চলে আয় অর্ঘ্য , আমার কোম্পানীর বিজ্ঞাপনগুলো লিখে দে । ভালো টাকা পাবি , জানিসতো বিজ্ঞাপন মানে মেয়েদের শরীর নিয়ে কারবার । তুই কবি মানুষ, মেয়েদের শরীরের কাব্যিক বর্ণনা তুই ভালোই লিখতে পারবি । তবে হ্যা অর্ঘ্য, তোর ঐ আদর্শ ফাদর্শ তোর বইয়ের সিন্দুকে জমারেখে আসতে হবে’। এরপর একটাই চিঠি দিয়েছিলাম সুদীপ্তকে, লিখেছিলাম” তুইতো ‘রক্তকরবী’ পড়েছিস সুদীপ্ত , ওধ্যাপকের সেই সংলাপটা মনে আছে ? সেই যে রক্তকরবীর অধ্যাপক বলেছিলেন আমরা যে সেই মরা ধনের শব সাধনা করছি । সোনার তালের তাল বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাবো হাতের মুঠোর মধ্যে”। তাইইতো মনে করিস তুই । তা করনা, আমি তো সে শবসাধনা শিখিনি যে ! এই বেশ আছি । আসলে কি জানিস সুদীপ্ত , রক্তকরবীর অধ্যাপকের ভাষাতেই বলি ‘উলঙ্গের কোন পরিচয় নেই, বানিয়ে তোলা কাপড়ে কেউ রাজা, কেউবা ভিখিরি’ । তোরই দাদা পৃথিবীটাকে যে ভাবে দেখতে শিখিয়েছে আমি সেভাবেই শিখেছি, তোর দাদাকে আমি অস্বীকার করবো কি করে সুদীপ্ত ?”। সেদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি মিতালির কথা । সুদীপ্তকে ভালোবেসে মিতালি ঠকেছে এ কথাটা এখনও বিশ্বাস করতে পারিনি । তবে আমি নিশ্চিত টাকার জন্য সুদীপ্তর ওপরে ওঠার আকাঙ্খা মিতালি মেনে নিতোনা । 



সুদীপ্ত মিতালিকে বিয়ে করবে, ওরা দুজনেই এই কথাটা আমাকে জানিয়েছিল । আমি আসানশোলে চলে আসার দিন পনেরো আগে মিতালির বাবা মারা গেলেন মেয়ের জন্য একরাশ চিন্তা নিয়ে । পরিবহন কর্মচারী ছিলেন ,ইদানিং বেতন পাচ্ছিলেননা নিয়মিত । খবরের কাগজে দুইয়ের পাতায় খবরটা দেখেছিলাম । ‘তোমায় আমরা ভুলছিনা ভুলবোনা’ এই সবও হয়েছিল । সহকর্মীদের চেষ্টায় কুড়ি পঁচিশ হাজার বকেয়া টাকাও আদায় হয়েছিল । কিন্তু সেটাকায় সংসারের হাঁ ভর্তি হয়না, ছোট ভাইয়ের স্কুলের বেতন আর বড়টার কলেজের বেতন হয়না । শবদেহের সামনে বসে মা কপাল চাপড়াচ্ছিলেন , মিতালির কি হবে ? মনে আছে, সুদীপ্ত মায়ের হাত ধরে বলেছিল ‘ভাববেননা মাসিমা, একবছরের মধ্যেই আমি মিতালিকে নিয়ে যাবো’ । আমি মিতালি আর আর কোন খবর পাইনি, দেবার মত খবর আর কিইবা ছিল ! বাবা মারা যাবার একবছরের মাথায় একটা তিন লাইনের চিঠি পেলাম । মিতালি লিখেছে “মা’ও চলে গেলেন মাস তিনেক হলো । ভাই দুটোকে নিয়ে আপাতত ফুলবাগান বস্তিতে একজন একটা টালির ঘর জোগাড় করে দিয়েছে । ভাই দুটো সঙ্গে রয়েছে যে , ওদের নিয়েতো হাড়কাটা গলিতে বাসা বাধা যায় না ! তোমার ছোট্ট মিতু মোটেই ভালো নেই অর্ঘ্যদা । তুমি ভালো থেকো দাদা , আমাকে মনে রেখোনা । সংসারী নাহয়ে কেন এতো কষ্ট পেলে অর্ঘ্যদা” । বুঝলাম মিতালি ঠকেছে , সুদীপ্তই ঠকিয়েছে ।

মিতালি
আমি একটা বোকা মেয়ে । অবশ্য মেয়েরা তো একটু বোকা হয়ই, নাহলে শরৎচন্দ্র এতো ভালো ভালো গল্প লিখলেন কিকরে ? না আমাকে নিয়ে কাউকে গল্প লিখতে হবে না, অর্ঘ্যদাকে কবিতা লিখতেও হবেনা । আসলে শেষটা কেমন হবে তাইইতো কেউ জানেনা, আমিও না । বুবুনদা অনেক ওপরে উঠে গেছে । ফুলবাগান বস্তির মেয়ের নাগাল সেখানে না পৌছানোই ভালো । অর্ঘ্যদাকে জানানো উচিত ছিল, জানিয়েছি । লিখেছি‌ আমাকে ভুলে যেতে । আসছে জুনে ছোট ভাইটা মাধ্যমিক পাশ করে যাবে , মেজটাও জয়েন্টএ বসবে । ওরা দুজন দাঁড়িয়ে গেলে অর্ঘ্যদার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, ক্ষমা করতে বলবো । না , ‘অর্ঘ্যদা তুমি আমায় গ্রহণ করো’ এই কথাটা বলতে পারবোনা ।

আমি আবার

সুদীপ্তর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়ে যাবে এটা আমি ভাবতেই পারিনি । আসানশোল স্টেশনের কাছেই আমার স্কুল । সকাল সাড়ে এগারোটা হবে , আমি সাইকেলে উঠতে যাবো, একটা ডাক শুনতে পেলাম “আরে এই সুদীপ্ত , দাঁড়া , একটা সিগারেটের দোকানে সুদীপ্ত সিগারেট কিনছে । অনেক দিনের পরিচয়, একটা শুকনো জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এখানে ? সুদীপ্ত বললো “অফিসের কাজে এসেছি, দিল্লী যাবার পথে এখানকার কাজটা সেরে নিলাম” । আমি বললাম, চ’ বাড়িতে যাবিতো ? বললো “আরে না না, আধঘন্টা পরে ট্রেণ । চা খাবি ? জানতে চাইলাম । বললো নারে চা ফা চলবে না বীয়ারে পেট ভর্তি হয়ে আছে, বরং চ’ কোথাও বসে একটা ঠান্ডা খাই । সুদীপ্ত জানতে চাইল কেমন আছি, বললাম ভালোই আছি । সুদীপ্ত একটা খোঁচা মারলো “সাড়ে ছ হাজার স্কুল মাষ্টারিতে ভালো আছিস ? থামিয়ে দিয়ে বললাম “অন্যকিছু বল সুদীপ্ত” । আর কিছু বললোনা, কয়েক সেকেন্ড পরে বললো ওহো , তুই তো আবার আমার মহাপুরুষ দাদার শিষ্য ! ট্রু মাকু ! উঠে দাড়াবার আগে একটা কথা জিজ্ঞাসা করলাম “মিতালিকে ঠকালি কেন ? । মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সুদীপ্ত বললো “কে মিতালি, সেই কালো রোগা মতো আন্ডার গ্রাজুয়েট মেয়েটা , আমার স্ট্যাটাসে ঐ কালো মেয়েটা মিসফিট অর্ঘ্য” । আমি ঊঠে দাঁড়ালাম । সুদীপ্ত দামটা দিতে গেলো , ঠান্ডা জলওয়ালা লোকটা নিলনা, বললো, “না না সাবজী মাষ্টারবাবুর বচপনের দোস্ত কিছু খাবে আর সে নিজের পাকিট থেকে দাম দিবে এই সিস্টেম আসানশোলে নেই সাবজী” , চলি, তোর ট্রেণেরও সময় হয়ে এলো’ । দামটা মিটিয়ে আমি সাইকেলের প্যাডেলে পা দিলাম ।

সুদীপ্ত

অর্ঘ্যটা একটা গাধা । ঠিক দাদার মত । দাদা জেলে পচলো তারপর সময় যখন এলো গুছিয়ে নিতে পারলোনা । যা, আমার দাদাটার মত টিবি রোগের সঙ্গে বন্ধুত্ব কর , পচে মর আদর্শবাদ নিয়ে । এই সব বিড়বিড় করে বলছিল এসি ফার্স্ট ক্লাসে কুপএ বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে । তার প্রজেক্টটার কথা ভাবছিল । পোডাক্ট মানে তাদের প্রসাধন কোম্পানীর একটা বিজ্ঞাপন লঞ্চ করা । সুদীপ্ত নিশ্চিত, তার নতুন বিজ্ঞাপনটা বাজারে ছাড়লে তাদের প্রোডাক্ট সেল অনেকগুণ বেড়ে যাবে । ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মিঃ কেজরিওয়াল তো সুদীপ্ত কে বলেই দিয়েছেন। , “প্রোডাক্ট সেল অন্তত ৩০ পারসেন্ট বাড়াতেই হবে , সে তুমি বিজ্ঞাপনে নাঙ্গা মেয়েলোকের ছবি দাও আর যাই করো” । ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কথা শুনে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়ে ছিলাম । মাখন বাবুকে খবর পাঠালাম মুশকিল আসানের জন্য । মাখন তার চাহিদা মত মডেলের সঙ্গে কথা পাকা করলে দিল্লী থেকে ফিরেই ফোটো শেসন করার কথা ভেবে রেখেছি । মাখন বলেছিল মিস ভার্গিস কে নিন স্যার, নয়তো মিস চৌহান, খুব নামকরা মডেল, দুজনেই খুব খোলামেলা ছবি দিতে অরাজি হয়না । মাখনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আরে না না মাখনবাবু পেশাদার মডেল আমার চাইনা, মেয়েদের শরীর এখন ক্লাস ফাইভের ছেলেদেরও জলভাত , আমার চাই কালো শীর্ণ বুকের এমেচার মেয়ে, একটু গ্রাম্য ফ্লেভার থাকবে । দেখবেন ফোটোগ্রাফারের সামনে না বলে বসে বুকের কাপড় এতোটা সরাবো না” । পান খাওয়া মুখে একগাল হেসে মাখন বলে “কিচ্ছু চিন্তা করবেননা স্যার, দারুণ জিনিস নিয়ে আসছি স্যার , দরকার হলে রাত্রে...”। মাখনকে থামিয়ে দিতে হ’লো ।

আমি আর একবার

মিতালির ছোট্ট চিঠিটাতে আমি ভয় পেলাম । ভেবে পেলামনা ও কেন লিখলো ‘তোমার ছোট্ট মিতু আর মোটেই ভালো নেই অর্ঘ্যদা’ । ভালো নেই মানে কি হয়েছে ? কে ভালো থাকতে দিলনা মিতালি কে ? ওই কথাগুলোই বা লিখলো কেন মিতালি ‘সংসারী না হয়ে কেন এতো কষ্ট পেলে অর্ঘ্যদা’! কোন ঠিকানা দেয়নি মিতালি । দেবে কেনো,আমি ওকে খুজি এটাইতো চায়নি মিতালি । এতবড় পৃথিবীতে কোথায়ইবা খুজে পাবো ওকে ? সুদীপ্তর কাছে ঠকবার পর মিতালি কি অন্য কোন স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল ? এর কোন প্রশ্নের উত্তরই আমার পাওয়ার কথা নয়, পাবোনা কোনদিন, কারণ আমি এ গল্পের কেউ নই ।

সুদীপ্ত

দিল্লী থেকে ফেরার পরদিন মাখনই সব ব্যবস্থা করে দিল । যে রকম ফোট দেখিয়েছিল মাখন সেরকমই কালো চেহারার শীর্ণ মেয়েটি নির্দিষ্ট টুলে এসে বসলো । তারই নির্দেশ মত হালকা শিফনের শাড়ি পরেছে, ভেতরে কোন অন্তর্বাস নেই । স্টুডিওর পাশেই চেম্বার, ক্লোজ সার্কিট টিভির বড় মনিটরে সবই দেখার ব্যবস্থা আছে । সুদীপ্ত মনিটরের সামনে বসে মাঝে মাঝে ইন্টারকমএ ছোটখাটো নির্দেশ দিচ্ছে । অভিজ্ঞ ফোটোগ্রাফার, সবই বলে দিয়েছে সুদীপ্ত । ফোটোগ্রাফার লেন্সে ফ্রেমটা একবার দেখে নিল, তারপর লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে বললো "ডানদিকের বুকের কাপড়টা একটু সরাতে হবে ম্যাডাম"। মেয়েটি জানতে চাইল – সবটা ? ফোটোগ্রাফার কিছু না বলে উঠে গিয়ে তা্র দরকার মত ডানদিকের শীর্ণ স্তনটা প্রায় উন্মুক্ত করে দিল । লাল আলো জ্বালিয়ে সুদীপ্ত পোজটা অনুমোদন করে দিল । অনেকগুলো পোজএ ছবি তোলার পর, বললো ঠিক আছে । ভালো কোঅপারেশন করেছেন , আপনার কাজ শেষ । মেয়েটি উঠে পোষাক বদলাতে এন্টি চেম্বারে ঢূকলো । ইতিমধ্যে মাখন এসে গেল, মেয়েটিও পোষাক বদলে চলে এলো । মাখন বললো, স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসুন । মেয়টিও বোধয় তাই চাইছিল । খুব অল্প আলো, সুদীপ্তর মুখটা চেনা যায়না । মেয়েটি ঢুকতে সুদীপ্ত বললো “কোন সমস্যা হয়নিতো” ? মেয়েটি মৃদুস্বরে বললো “বিছানায় যেতে হবে নাকি ? মাখন বাবু বলছিলেন”...। সুদীপ্ত শুধু বললো টাকা পেয়েছেন ? ঘাড় নাড়লো মেয়েটি, সুদীপ্ত বললো আবার খবর দেব । সুদীপ্ত চেম্বারের লাগোয়াই লিফট । দরজার হাতলে হাত রেখে কয়েক মুহুর্ত থমকে দাঁড়াল মেয়েটি, তারপর বললো “অনেক ওপরে উঠেছ, তাইনা বুবুনদা ? আসলে কিন্তু তলিয়ে যাচ্ছো বুবুনদা, তলিয়ে গেছ”। দরজা খুলেই লিফটের বোতামে হাত দিল মেয়েটি, সুদীপ্ত কিছু বোঝার আগেই । ধাতস্থ হতেই মাখনের ডাক পড়লো । জিজ্ঞাসা করল “মেয়েটিকে কোথা থেকে আনলেন মাখন বাবু ? নাম কি” ? মাখন একটা পান মুখে গুজে গদগদ হেসে বললো “বলেছিলাম না স্যার, দারুণ জিনিস । আর একবার ডাক পাঠাবো স্যার ? খুব অভাবি মেয়ে স্যার” । দৃশ্যত বিরক্ত সুদীপ্ত বললো “আহ, যা জানতে চাইছি বলুন, নাম কি, থাকে কোথায়” ? মাখন জানায়, ফুলবাগানে এক বস্তিতে থাকে, আগে বর্ধমানে না কোথায় থাকতো , নাম মিতালি ।

আমি

স্কুলে যাওয়ার পথে নজরে পড়ল একটা বিরাট হোর্ডিং, কি একটা প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন, একটা প্রায় বিবস্ত্র মেয়ের ছবি রয়েছে । ওসবে আমার আগ্রহ নেই , যায়গাটা এতদিন খালি ছিল, তাই চোখে পড়লো । দিন তিনেক পরে একটা চিঠি পেলাম । ঠিকানা নেই। নামটা দেখে বুঝলাম মিতালির চিঠি । লিখেছে – “আমাদের তিনজনের মধ্যে শুধু তুমিই মাথা উঁচু করে, মেরুদন্ডটা সোজা রেখে বাঁচতে পারলে অর্ঘ্যদা , বুবুনদার তলিয়ে যাবার কথাটা তুমি জানো কিনা জানিনা, আমি জানি অর্ঘ্যদা । আমিও অনেক নিচে তলিয়ে গেছি অর্ঘ্যদা, তোমার আদরের মিতু অনেক তলিয়ে গেছে । দোহাই অর্ঘ্যদা , আমাকে খুঁজো না । তুমি ভালো থেকো” ।


---- X------







আমাদের পাঠশালা 






অ র্ধে ন্দু শে খ র গো স্বা মী 






আমাদের পাঠশালা-সবাই বলত ছোট ইস্কুল, ছিল আমাদের গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে খোলা মাঠের মাঝখানে । এঁটেল মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে মধ্যিখানে আস্ত একটা গ্রাম পেরিয়ে তবে ছোট ইস্কুলে পৌঁছানো যেত । সাঁতার ও বৃক্ষারোহণ পটু ছ'বছরের এই বালকটির কাছে ওইটুকু রাস্তা হাঁটা বিন্দুমাত্র ক্লেশের কারণ না হলেও পণ্ডিতমশাইদের সান্নিধ্যে অতখানি সময় অক্লেশে অবস্থান করাটা নিদারুণ কঠিন ব্যাপার ছিল। তিনজন পণ্ডিতমশাই-এর মধ্যে ভবপনশয় আরছোট পনশয়কে বিশেষ ভয়াবহ বলে মনে না হলেও বড় পনশয় ছিলেন একাই একশো । তিনি দূর গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় সারা সপ্তাহ আমাদের গ্রামেই থাকতেন আর সপ্তাহান্তে শনিবার সাইকেলে চেপে নিজের বাড়ি যেতেন। সোমবার বাড়ি থেকে আসতে তাঁর একটু দেরিই হত । কদাচিৎ এমনও হত যে সোমবারটায় তিনি আর এলেনই না। তাঁর সেই দুর্লভ অনুপস্থিতির প্রার্থনায় আমরা দুরু দুরু বক্ষে রাস্তার দিকে চেয়ে বসে থাকতাম আর অনেক দূরে সাইকেলের উপর তাঁর সাদাচুলো মাথাটি নজরে আসা মাত্র চোখে অন্ধকার দেখতাম,বুকের মধ্যে চেপে বসত চাপা বিষাদ। স্মৃতিতে ওই হতাশার কষ্টটাই মনে ভাসে,তাঁর দৈবাৎ অনুপস্থিতির উল্লাসটা নয়।


তিন পণ্ডিতমশায়ের একজন বড় পনশয়,একজন ছোট পনশয় হলেও বাকি জন মেজ বা মধ্যম না হয়ে ভব পনশয় কেন হলেন তা ব্যাখ্যার অতীত । ছোট জন বাদ দিলে অন্য দুজন ছিলেন ব্রাহ্মণ। তখন ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ভেদরেখা বেশ প্রকটই ছিল এবং শিশুবয়স থেকেই সেই জ্ঞানটা আমাদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে গুরুজন এবং শিক্ষক হওয়া সত্বেও ছোট পনশয়কে আমরা পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম না । আমরা মানে বামুনছেলেরা, কেননা, তুলসি পাতার ছোট-বড় নেই। এই ভেদজ্ঞান অচিরেই পরিত্যক্ত হলেও কারুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করার সঙ্কোচটা এখনও বিদ্যমান। 


বড় পনশয়ের নাম বিভূতি ষন্নিগ্রহী, দ্বিতীয় জন ভবতোষ গোস্বামী – এঁরই নামের আদি দু'অক্ষর 'মেজ'র পরিবর্ত হিসাবে অজানা কারণে 'পনশয়'এর অগ্রবর্তী 


হয়েছিল। শেষজন হলেন সমরেন্দ্র মান্না । ভাবতে অবাক লাগে পরবর্তী কালে কত মানুষের সঙ্গে সাময়িক চেনাজানা,মেলামেশা হল- এঁদের মধ্যে আমার কলেজ শিক্ষকেরাও আছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অল্প জনের কথাই আজ মনে পড়ে। অথচ,মাত্র বছর চারেক যাঁদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি,সেই পণ্ডিতমশায়দের নাম,প্রকৃতি,মুখচ্ছবি,স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। শৈশব কী গভীরভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এসবই তার উদাহরণ । তিনজন ছিলেন তিন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। বড় পনশয়ের ছোটখাটো চেহারা, গায়ের রঙ তামাটে,চুলগুলি সব ধবধবে সাদা । এই সাদা চুলের জন্যই আমরা তাকে বুড়ো ভাবতাম । আসলে তিনি মোটেও বুড়ো ছিলেন না,অল্প বয়সেই তাঁর চুলগুলি সব পেকে যায়। তিনি ছিলেন অসম্ভব ক্রোধী এবং জেদী। পড়ানোর সময় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টা ছাত্রছাত্রীদের মগজে ঢোকানোর চেষ্টা করতেন। যখন দেখতেন আকাট মগজে সেটা ঢুকছে না, তখন তার রিনরিনে মেয়েলি গলার পরদা চড়তেই থাকত-গলার জোর দিয়ে তিনি মগজেr দুয়ার খুলবেনই। তাতেও যখন অবোধ শিশুগুলি সন্ত্রস্ত হয়ে ফ্যালফ্যাল করে নীরবে তার দিকে তাকিয়েই থাকত,তখন আর ধৈর্য রাখতে না পেরে তিনি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে তাঁর রুল- বাড়ি নামক হাতিয়ারটি চালনা করতেন। ছাত্রছাত্রীদের মাথার বা গায়ের চামড়া ফেটে রক্তপাত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। অভিভাবকদের কাছে বিভূতি মাস্টারের খুব কদর ছিল। উনি গাধাকেও পিটিয়ে ঘোড়া বানাতেন বলে তাঁদের বিশ্বাস । 


চুলের রং বাদ দিলে ভব পনশয়ের আকৃতি ও গায়ের রং বড় পনশয়ের প্রায় অনুরূপ ছিল। তবে বড়োর যেমন চুল,ভব পনশয়ের তেমনি দাঁতগুলি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তাঁর উপরের পাটির কোদালাকৃতি দাঁতগুলির অধিকাংশই অধরের বাইরেই অধিষ্ঠান করত । ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তাঁর বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। কেউ পড়া বলতে না পারলে তার পেটে চিমটি কাটা ছাড়া বাকিটা সময় তাদের আপনমনে থাকতে দিয়ে তিনি অবিশ্বাস্য নিপুনতা এবং অধ্যবসায়ে একটা দেশলাই কাঠিকে ব্লেড দিয়ে চিরে তিন বা চার খণ্ডে পরিণত করে তাঁর বিড়ি জ্বালনের খরচ কমানোয় সচেষ্ট থাকতেন। তিনে তিনি সর্বদাই সফল হতেন,কিন্তু চার করতে গিয়ে ক্বচিৎ কখনও ব্যর্থ হলে তাঁর হাতে থাকত মাত্র দুই। তেমন দুর্ঘটনার সময় সাগ্রহী পর্যবেক্ষক তাঁর কোন পড়ুয়া হেসে ফেললে তিনি কুপিত না হয়ে তাঁর দিকে একবার করুণ নেত্র- পাত করতেন মাত্র;পরক্ষণেই অধিকতর অভিনিবেশ সহকারে নিজের কাজে মগ্ন হতেন।বিড়িওতাঁকে একবারে শেষ করতে দেখা যায়নি কখনও,নিভিয়ে রেখে দুই বা তিনবারে শেষ করতেন । তাঁর মিতব্যয়িতা ও অধ্যবসায় পরবর্তী জীবনে কাজে দিয়েছিল। ম্যাট্রিক পাশ ভব পনশয় বেশী বয়সে আই এ,বি এ ও সংস্কৃতে স্পেশাল অনার্স পাশ করে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে শেষ পর্যন্ত


তাঁরই গ্রামের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রূপে কর্মজীবন শেষ করেন। তখন তাঁর পোশাক-আসাকের পারিপাট্যের কারণে আমাদের ভব পনশয়কে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। 


রোগা,লম্বা ও কালো ছোট পনশয় আমাদের মনের মত মানুষ ছিলেন। শুধু তাই নয়,অন্তত আমার চোখে আমি তাকে সর্বাধিক সুন্দরও দেখতাম। মুখে মিষ্টি হাসি,ঠাণ্ডা 


মাথায় তিনি ছোটদের পড়া বুঝিয়ে দিতেন। আর যেটা বিশিষ্টভাবে তাঁকে অন্য দুজনের থেকে আলাদা করেছিল সেটা তাঁর কণ্ঠস্বর। বড় পনশয়ের রিনরিনে মেয়েলি গলা,ইস্কুলে তাঁর দোর্দণ্ড-প্রতাপ সত্ত্বেও গ্রামের যাত্রাপালায় তিনি মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন । ভব পনশয়ের ঘড়ঘড়ে শ্লেষ্মা জড়িত আওয়াজ,অভিনয় করলে তাঁকে বৃদ্ধের রোল দেওয়া যেতে পারত। এঁদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র,ছোট পনশয়ের কণ্ঠস্বর ছিল ভরাট,পুরুষালি অথচ সুরেলা। আজ বুঝতে পারি তখন থেকেই আমার পছন্দ-অপছন্দের বোধ জাগতে শুরু করেছিল। পরবর্তীকালে,আজ পর্যন্ত মানুষের মুখশ্রী বা শরীরের গঠন অপেক্ষা তার কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গিই আমাকে বেশী করে আকৃষ্ট করে। 


আমার ছাত্রজীবনের প্রথম বাহবাটা আমি ছোট পনশয়ের কাছেই পাই। বড় পনশয় সাধারণত চতুর্থ শ্রেণীর ছেলেমেয়েকে পড়াতেন। তৃতীয় শ্রেণীর অঙ্কটাও বোধ হয় তিনিই দেখতেন। বাকি বিষয়গুলো ছিল ভব পনশয়ের দায়িত্বে। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত দুটো মাত্র বিষয় । অঙ্ক আর বাংলা। সেগুলো ভব-ছোট ভাগাভাগি করে পড়াতেন। শুরুর পড়ুয়ারা সবাই ছিল ছোট 'র দায়িত্বে । স্কুলে যাই । বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ শেষ হয়ে দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয়েছে। একদিন ছোট এলেন না স্কুলে । বড়োর কী খেয়াল হল কে জানে ভবকে না বলে নিজেই বসে গেলেন শিশুদের নিয়ে। আর পড়বি তো পড় আমাকে নিয়েই পড়লেন। বানান ধরতে লাগলেন। দ্বিতীয় ভাগের যুক্তাক্ষর শব্দ!


প্রথম ভাগটা কোনরকমে মুখস্থ করে চালিয়েছি, দ্বিতীয় ভাগের জটিল শব্দের বানান কাঁহাতক আর মনে রাখা যায়।বড়োর পূর্ববর্ণিত পাঠন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হতেই আমার প্রতি চিৎকৃত আদেশ-এক ঠ্যাঙে দাঁড়া! 


দাঁড়ালাম।


-কান ধর! 


ধরলাম।


তারপরেই তাঁর রুলবাড়ি চলতে লাগল আমার পায়ে। বাড়ি খেয়ে মাঝে মাঝে এক ঠ্যাঙ থেকে দু-ঠ্যাঙ হয়ে যাই। সন্ত্রাস-সচকিত বাঁ পা মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই আবার উঠে পড়ে ডান পায়ের উপরে। অবশেষে যখন রেহাই পেলাম,তখন রক্তরাগলাঞ্ছিত পা ফুলে ঢোল। সেই ঢোল পা আর অশ্রু কপোলিত বদনে বাড়ি ফিরে যে সাদর অভ্যর্থনা মিলবে না সেটা জানাই ছিল। তবুও অন্তত মা সন্ধেবেলায় গরম তেল দিয়ে পা মালিশ করতে করতে অন্যদের কান বাঁচিয়ে অস্ফুট মন্তব্য করেছিলেন,- চণ্ডাল ! কার উদ্দেশ্যে শব্দটি বর্ষিত হয়েছিল তা বুঝতে সেই বালক বয়সেও আমার অসুবিধে হয়নি । এদিকে বাবার কাছেও যথারীতি রিপোর্ট পৌঁছেছিল। পরদিন সকালবেলায় আমাকে ডেকে বললেন,-আজ আর ইস্কুলে গিয়ে কাজ নেই,তোমার বই খাতা সব নিয়ে এস দিকি । বাবা'শব্দের উচ্চারণে প্রতিটি বার আমার গলা বাস্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে,বোধ করি হয়ে উঠবে আজীবন। তো সেসব কথা এখানে নয়। সেদিন বাবা আমাকে নিয়ে ঘন্টা তিনেক বসেছিলেন টানা।


অক্ষরের সঙ্গে অক্ষর জুড়ে যে ধ্বনিসমন্বয় শব্দ তৈরি করে এবং সেই সব শব্দেরা যে আমাদের মুখের ভাষার শব্দের অনুরূপ অর্থের আধার - এই বোধ কোন ভাষায়,কী পদ্ধতিতে বাবা,আমার মাথার মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিলেন,তা আজ আর আমি বলতে পারব না;শুধু মনে আছে ,হঠাৎই বিদ্যুৎ ঝলকের মত ঝলসে উঠল বোধ।শব্দ নির্মাণ,যা এতদিন ছিল প্রহেলিকাবৎ,এক নিমেষে কী কৌশলে আত্মস্থ হয়ে গেল ।


পরের দিন ইস্কুলে গেছি। দ্বিতীয় ভাগ খুলে বসেছি। ছোট পনশয় বললেন,-


ওটা রাখ, প্রথম ভাগটা বের কর । সম্ভবত তা বড়রই নির্দেশ ছিল,কী,না ওটা কিচ্ছু শেখেনি,আবার প্রথম থেকে শুরু করুক। আমি গড়গড় করে 'অজ,আম,কর,খল' থেকে শুরু করে গোপাল ও বেণীর আখ্যান পর্যন্ত একটুও না থেমে পড়ে শেষ করলাম। বিস্মিত ছোট পনশয় তখন দ্বিতীয় ভাগের 'ঐক্যমাণিক্য,জাড্যমান'ইত্যাদির বানান জিজ্ঞেস করলেন এবং নির্ভুল উত্তরের সঙ্গে "জাড্যমান মানে কী,বলব পনশয়?"শুনে যথার্থই হতভম্ব হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল,- ব্বাঃ ব্বাঃ!


আর আমি অর্জন করলাম আত্মবিশ্বাস । সেদিন থেকে ইস্কুলের রংটা আমার চোখে পালটে গেল । 









শুধু তোমারই জন্য 



শি দ্ধা র্থ শ র্মা 

শেষ বিকেলের আকাশটা ভারী সুন্দর আজ, একমুঠো আবির ঢেলে দিয়ে দিনমণি রাজ্যপাট গুটিয়ে ঘরে ফেরার পথে ভারী সুন্দর করে সেজে ধরণী বিদায় জানাতে প্রস্তুত হয়েছে । ঘর ফেরতা পাখির দল কিচির মিচির করে আজান দিয়ে যায় । তন্ময় হোয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হিমেল সুগন্ধী বাতাসে ভেসে বাসায় ফিরছিল সোহম,কর্মব্যাস্ত আরেকটি দিন শেষ হোয়ে গেল .... মৃদু একটা হাসি খেলে যায় সোহমের ঠোঁটে । এর পরেই তো সদ্য গ্রাজুয়েট হওয়া সোহমের নিজস্ব সময় পড়ার ঘরে বসে একটা দুটো চাকরির আবেদনের-এর মুসাবিদা - বুকে জড়িয়ে মানুষ করা পিসিমার সাথে একটু গল্প আর তার পরেই - কবিতার খাতা খুলে বসা আর ভালোবাসাকে ভালোবাসাতে তলিয়ে যাওয়া । 






বাড়ির কাছাকাছি এসে মন মুগ্ধ করা সুরেলা রাগিনী গতি কমিয়ে দেয় , পাশের বাড়ির পিয়া ভৈরবী তান ধরেছে। সারা আকাশ বাতাস ওর সুন্দর কন্ঠস্বরে মেতে উঠেছে । ওর গানের গলা চমত্কার - অনেক সময় মালা জপতে থাকা পিসিমাকেও দেখেছে চোখ বুজেছে ওর গান শুনতে গিয়ে সোহম সারা অনুভবে এক সুন্দর গন্ধরাজ লেবুর সুগন্ধ অনুভব করে হাত মুখ ধুয়ে চা মুড়ি খেয়ে পড়ার ঘরেতে গিয়ে বসেছে , হঠাত চমক ভাঙ্গে - পিয়ার ব্যস্ত সমস্ত ডাকে "সওম দা সওম দা .. দেখো! দেখো ! আমার কবিতা বেরিয়েছে ছেপে ! অমিত দাই জোর করে আমাকে বললো লিখতে আর ওর জানা এই পত্রিকা-" অনুপমা" তে ছাপিয়েছে, পূজা সংখ্যাতে ! "কই দেখি " সোহম এক নিমেষে হারিয়ে যায় -অমিত ! অমিত রায় ! ঝকঝকে ! চকমকে ! স্মার্ট ! কেতাদুরস্ত ! চাকুরী না পেয়ে ধনী ঘুসখোর বাপের পয়সাতে ঝট করে আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের, ফিফথ এভেনিউএর পিচুটি এখনো চোখে লেগে থাকা ... আঙ্গুলে হার্লি ডেভিডসনের- চাবি ঘুরানো অমিত রায় ! 






জীবনে সব পেয়েও সোহম-এর সযত্ন লালিত এই সুন্দর কোমল স্বর্ণলতার প্রতি এমনি কেন দুর্বার আকর্ষণ ! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গহীন অন্তস্থল থেকে । সব ক্ষেত্রেই হারতে হারতে এই নরম জাগাটাও হারাবার ভয় সোহম কে পেয়ে বসে "এগারো ক্লাস -এ পড়া এই মেয়েটি যাকে পড়া বোঝাতে গিয়ে বকবার মায় কান ধরবার অধিকার একমাত্র সোহামেরই আছে সেই পিয়াকেও! ঝাপসা হোয়ে যাওয়া চোখে সোহম ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে উত্সুক পিয়া তাকিয়ে ! "ক্যামন হয়েছে ? "ভালো" শুধু ! ভালো ! হু ,এর পরেই ঠাস করে একটা প্রশ্ন "তোমার কবিতা কবে ছাপবে ? "আরে ধুস , এখনো তো আমার প্র্যাকটিস পিরিয়ড চলছে !" সোহম মিন মিন করে বলে -"রাখতো তো তোমার প্র্যাকটিস সেসন, খাতা গুলো তো কবিতা লিখে লিখে ভরিয়ে ফেললে , একটাও ছাপার অক্ষরের মুখ দেখল না । ভারী আমার প্র্যাকটিস পিরিয়ড চলছে!" এ কি করলো! পিয়া ! যেন ঠাস করে একটা চড় কসিয়ে দিলো সোহমের গালে .... সোহমের শেষ অবলম্বন টাকেও .... এভাবে মাড়িয়ে দিলো ! ক্লান্ত চোখে রিক্ত অনুভবে সোহম তার ভালবাসার মানুষীর স্পর্ধিত পদচারণা দেখতে থাকে,ওর বুক তা গুড়িয়ে যায় । 






বেশ কিছুদিন কেটে যায়, সোহমের কাছে শুভ্র সকালের সৌন্দর্য ম্লান, বিকেলের আকুলতা কিংবা রাতের চাঁদনী কিছু আর আলাদা করে কোনো অনুভুতি আনেনা । খিদে পায় না শরীরটাকে কোনমতে বয়ে নিয়ে যাওয়া আর আসা । সেদিন এমনি যেতে যেতেই কলেজ স্ট্রীট কফি হাউস থেকে বেরিয়ে মাসুদের থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধোয়া উড়িয়ে পাতিরামের স্টলে লিটল ম্যাগাজিন গুলো একটু নাড়াচাড়া করে নাক ভরে সুগন্ধ নেবার জন্যে "আরে ! সোহম ! গুরু ! কি খবর .... লিখছিস টিখচিস এখন ? দ্যাখ আমার সম্পাদনায় একটা লিটল ম্যাগাজিন বার করেছি .... সোহম দেখে একটা চটি ম্যাগাজিন ..... বেশ প্যাঁচ কষে তাতে নাম লিখেছে "অন্বেষা " মসিয়ুর তুইও কবি হোয়ে গেলি ! কেমন একটা তেতো বিস্বাদ মন নিয়ে সোহম ফিরে আসে । বেশ একটু অন্ধকার আর শীত শীত বোধ নিয়ে - অভ্যেস মতোন দোতলার পিয়ার ঘরটাতে চোখ ফেলে, ভবেশ কাকুর বন্ধু অমিত রায় এর বাবা র গলা গম গম করছে । সোহম অন্ধকারে সিটিয়ে গিয়ে কোনমতে শরীর -টাকে টেনে টেনে নিয়ে আসে । ঘরে ঢুকে সারা মন প্রাণ একাত্ম করে ওর সব অনুভব দিয়ে লিখে ফেলে একটা কবিতা "শুধু তোমার -ই জন্যে !" সারা শরীর তপ্ত .. জ্বরগ্রস্ত হিস্টেরিয়া রুগীর মত উঠে নোট বই থেকে কবিতাটা ছিঁড়ে ফেলে, তারপর বিছানাতে মুখ গুজে শুয়ে থাকে । কত যে রাত হয়েছে খেয়াল নেই, কেবল মাথাতে নরম হাতের ছোঁওয়া পেল একবার ....অভিমানে আরো গোঁজ ধরে শুয়ে থাকলো সে । 






এর পর বেশ কিছুদিন কেটে যায় - জীবনের অনেক না পাওয়ার লিস্ট-এ এটাও জুড়ে যায় - ধীরে ধীরে সোহম বুঝে গেছে বাস্তব আর জীবন সত্যের গতানুগতিকতায় ফিরে এসেছে । ধীরে ধীরে এমনি -ই একদিন ফিরে এসে ঘরে আলো জ্বালাতে যায় । ওই দূরে কে বসে ওর চেয়ারের হাতলে ? কখন থেকে বসে আছে ও ? স্কুলের পোশাক -ও ছাড়ে নি এখনো ! কেমন ক্লান্ত বিধ্ধস্ত মুখ .....
"সওম দা ..." শির দাঁড়া বেয়ে সেই চেনা আনন্দের স্রোত , সেই ঝরনার কলতান - সেই মনের মাঝে নদীর কুল কুল অনুভব .. সেই ভালো লাগা .... "হম বল .... কি বলবি ? "দ্যাখো এই ম্যাগাজিন টা” ,ওর সামনে একদম ঘনিষ্ঠ .... সোহমের ইচ্ছে করে ওই সুগন্ধি নিশ্বাস সারা জীবন প্রাণ ভরে নিতে । পিয়া তুলে দেয় সোহমের হাতে ‘অনুপমা’র বইমেলা সংখ্যা । সোহম এড়িয়ে যেতে চায় । "না সওম দা - আজ এটা তুমি দেখবে .. এটা তুমি পড়বে!" পাগলিটা কতদিন পর এমনি দাবি নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ! সোহমের মন আবেগে নরম হোয়ে যায় - বলে "তোর নতুন কবিতা বেরিয়েছে বুঝি ? দেখি দেখি "কিন্তু একি ! কি লেখা এতে ? কার লেখা এতে ? ‘শুধু তোমার ই জন্যে’ সোহম সিনহা । সোহম -এর প্রথম কবিতা । ছাপার অক্ষরে ! সোহম হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে , জড়িয়ে ধরে ওর পিয়া , প্রানের প্রিয়া কে,ওর ভালোবাসাকে "পাগলি ! তুই একটা পাগলি ! বুঝলি একটা আ.... পাগলিই ...তুই ই ই ই ই ..পাগলিটা সেই থেকে স্কুল ড্রেস না ছেড়ে না খেয়ে বসে আছে শুধু সোহমের জন্যে! ঝট করে কোলে তুলে চারপাক খেতে থাকে পাগলের মত সোহম । ওর ভালবাসা ওর জীবন ওর সবকিছু ওর কাছে । সোহম ডুবে যায় এক নরম অনুভবে , সারা পৃথিবীর ভালবাসা দুই বাহুর মাঝে ... খিল খিল হাসির এক মুঠো রোদ্দুর আর অভিমানের মেঘ ঝরা চোখের এক পশলা বৃষ্টির জল মিলে মিশে একাকার হ’য়ে যায় ।









আগমনী











আনোয়ার হুশেন






আজকাল বেশ ব্যস্ত থাকি । অনুমান করতে পারিনা কখন দিনের দ্বি-প্রহর কিংবা কখন রাতের দ্বি-প্রহর। রাত্রি দ্বি-প্রহরে বিছানায় যাই আর দিনের দ্বি-প্রহরে শয্যা ত্যাগ করি। বিকেলটা ভালোই কাটে- একদল বন্ধু -বান্ধব মিলে চৌরঙ্গী কিংবা প্রান্তিকে আড্ডা জমাই। সে আড্ডায় দেশের রাজনীতি , সমাজ নীতি , অ্যাডাল্ট কৌতুক কিংবা ওল্ড থেকে লেটেস্ট কোন ব্যান্ডের সুরম্য সংগীত-কিছুই বাদ যায় না। যে যেভাবে যেখান থেকে পারে দু’এক কলি গায় । আর আড্ডার পাশ দিয়ে কোন মেয়ের অতিক্রমণ ভোকালের গলার জোর কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। এরপর সবাই মিলে জোরে জোরে হাসে ডিপার্টমেন্টে ক’টি কোর্স পড়ানো হচ্ছে কিংবা কোন্ কোর্সের টিউটোরিয়াল কবে হচ্ছে----আমার বিশাল ব্যস্ততার মাঝে এগুলো স্থান পায় না । আমি প্রায়ই গেয়ে উঠি দিন যায় দিন চলে যায় / রাত যায় রাত চলে যায় / সময়তো বাধা মানেনা /-






--সেদিন কলা ভবনের দিকে যেতেই হঠাৎ করে আগমনীর সাথে দেখা। দেখা হলেই কুশলাদি বিনিময় হয় । টুকটাক কথা হয় । আমি আজকাল কেন যেন বান্ধবীদের সাথে বেশিক্ষন কথা বলতে পারিনা । হয় প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলি অথবা আনইজি ফিল করতে থাকি । জানিনা কেন এটা হয়। কিন্তু কেন যেন ওর কথা শুনতে ভাল লাগে । কথাগুলো লবনাক্ত। এগুলোর বেশিরভাগই হয় শ্রোতা অথবা প্রতিপক্ষকে আক্রমন করে বলা ।আমার মনে হয় এর মধ্যেও বন্ধুত্বপূর্ণ একটা কিছু আছে । নইলে ওকে অ্যাভোয়েড করতে পারিনা কেন ? মাঝে-মধ্যে আগমনী ফোন করে। আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীনতা কিংবা ইররেসপনসিবিলিটি নিয়ে প্রায়ই শানানো ভাষায় অভিযোগ করে। ছোটকাল থেকেই আমার ওপর কারো খবরদারি ভালো লাগেনা। ওর কন্ঠে তেতো আছে সত্যি । তবে মাঝে মাঝে মনে হয় এর মধ্যে কিছুটা দরদের মিশ্রণও আছে । নইলে অবজ্ঞা করতে পারিনা কেন ? এখন কোন মায়াবী মুখ, ডাগর চোখ, মুহুর্তেই আমাকে কবিতা লেখাতে পারেনা কিংবা কোন সুবিশাল প্রাপ্ত্রিও আমাকে কাঁদাতে পারেনা শ্রাবণের অঝোর ধারায়। কেমন যেন হয়ে গেছি। আজকাল একটা স্বভাব হয়েছে---এমনি এমনি হঠাৎ করে গান গেয়ে উঠি। সেদিন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কী যেন একটা আলোচনা চলছিল । আমি এর মধ্যে হঠাৎ করে গেয়ে উঠলাম “ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরেনা ।“ সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল । খারাপ না । সংগতিবিহীন জীবন যাপনে কোথায় যেন একটা মজা আছে। 






ক্লান্তি লাগেনা ! আগমনীর শিল্প, সাহিত্য,নন্দন তত্ত্ব সম্পর্কে বেশ জ্ঞানগর্ভ ধারণা আছে । মাঝে মধ্যে বেশকিছু কথা বার্তা দূর্বোধ্য লাগে । ভাবি ওটা হয়তো জ্ঞানগর্ভ কোন কথা । পাত্তা দিই না । জ্ঞান গর্ভ কথা ভাল্লাগে না । সুপারি বাগানে আড্ডা দিচ্ছিলাম । ওর কথায় আমার মনোযোগ নেই বুঝতে পেরে ও বললো , “চল, একটু চৌরঙ্গীর দিকে হাঁটি ।” আমি কেন যেন অমত করতে পারলাম না। দু’জনে কলা ভবনের পেছনের পুকুর পাড়ে বসলাম ।আজ অনেকদিন পর বুকের ভেতর একটা বিশাল শূণ্যতা স্থান করে বসেছে । ও হয়তো আমার মনের সঙ্গতিবিহীনতা পড়তে পারে। ও আপন মনে বলে উঠল , লেট বাই গান , লেট বাই গান’ আমার সন্দেহ হলো কিন্তু ধরা দিলাম না। ও আমার দিকে তাকালো । চোখ দুটো মায়াবী। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি মিথ্যে বলতে পারিনা । কেমন একটা অনাবিষ্কৃত রহস্য রয়ে গেছে ওর চোখে। আকাশ মেঘলা । বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দু’এক ফাঁলি দমকা বাতাস দীঘির জলে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমি আনমনে এসব লক্ষ্য করছিলাম । আগমনীর দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম ও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি একটু আন্‌ইজি ফিল্ করলাম । আমি বললাম, ” চল্ উঠি , বৃষ্টি হবে “। আগমনী নির্বিকার আমার দিকে তাকিয়ে । ওর দৃষ্টিতে ক্যামন একটা বিষাদ, মায়া আর শূণ্যতার আঁচ পেলাম । আগমনী উদাসী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ তন্ময়, আমার একটি ছেলেকে ভালো লাগে। তার সমস্ত দু:খবোধ গুলোর ভাগ নিতে ইচ্ছে করে । অথচ আমি তাকে মূখ ফুটে বলতে পারছি না “ । আমি বললাম , ”তোর একটি ছেলেকে ভালো লাগে --- তাকে বলে ফেললেই হলো ।” আগমনী বললো , “ও আমার নি:শ্বাস আর অস্তিত্বে এতটা মিশে আছে যে আমার সমস্ত অনুভূতি গুলো ওর কাছে গিয়ে বোবা হয়ে যায় ।”কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম , আগমনী কাঁদছে । আমি অপ্রস্তুত হলাম । কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ও আমার কাছাকাছি এগিয়ে এলো । আমার হাত ওর হাতে তুলে নিয়ে বললো, “ তন্ময় , সেই ছেলেটি তুমি ।” প্রচন্ড ঝড় এলো । চৌরঙ্গী ও লেকের আশপাশের সবাই ছুঁটছে। আমি উঠে দাড়ালাম । এক দৌড়ে কাছের যাত্রী ছাউনীতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম । আগমনীও আমার পিছুপিছু দৌড়ে যাত্রী ছাউনীতে আশ্রয় নিল । আমি আগমনীর দিওর চোখ দিয়ে তখনও জলপড়ছে । আমি নির্বাক আর স্তব্ধ হয়ে রইলাম । ঝড় কিছুটা কমেছে। কিন্তু ‍মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । চৌরঙ্গী কিংবা তার আশেপাশে য়ামরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আমি শক্তি সঞ্চয় করে আগমনীকে বললাম, “ চোঁখ মোছো । এখনও যে কেঁদে চলেছ ।” আমি অনেক কষ্টে নি:সাড় হাতে ওর চোঁখ মুঁছিয়ে দিলাম । বললাম, “ কেঁদোনা আগমনী , আমার কথা শোন ।” ওর কান্না কিছুটা কমেছে । আমি বললাম, “আগমনী , তোমার ভালোলাগায় কোন অপরাধ নেই । তোমার শিল্পী মনে তৈরি ভাস্কর্যে কোন খুঁত নেই। “ তুমি আমাকে জানো, আমার বর্তমানকে জানো। আজকের এই আমি এক তিক্ত স্মৃতির কন্টকাকীর্ণ অতীতে ঢাকা পড়ে আছি। আগমনী আমার আরও কাছে এগিয়ে এলো।লক্ষ্য করলাম , ওর মুখায়বয়বে এক দৃঢ়তার ছাঁপ । ও বললো, “ আমি তোমার গতস্য অতীত, চলমান বর্তমান আর অজানা ভবিষ্যত ----সব মিলিয়েই তোমাকে ভালোবাসতে চাই।” আমি স্পষ্ট বললাম, “আমার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে , আগমনী , ইচ্ছে করলেই আমি পেন্সিলে লেখা ভুল শব্দের মতো ইরেজার ঘঁষে মুঁছে ফেলতে পারিনা আমার অতীত ।” আগমনী বললো, হয়তো তোমার ফেলে আসা অতীতে কোনো বেদনাদায়ক স্মৃতি রয়েছে , যা তোমার হৃদয়গহনে সূচনা করেছে এক গভীর ক্ষতের। আমি তোমার অতীতকে অবজ্ঞা বা অবহেলা না করেই বলছি , এত কিচুর পরও কিন্তু আমরা চলমান বর্তমান আর অজানা ভবিষ্যতের বন্দনা করেই বেঁচে থাকি । “ আগমনী এখন আর কাঁদছে না । ওর মুখে ফুটে উঠেছে ওর সহজাত সারল্যের মায়াবী ছাপ । বৃষ্টি এখনও পড়ছে । পাশের ঝাউবণে দু’টি পাখি কিচির মিচির ডাকছে। বৃষ্টিতে ভিজে ওদের ডানা দুটি ভারী হয়ে উঠেছে । ওরা খুঁজে ফিরছে নিরাপদ আশ্রয় ।






বৃষ্টির আঁচ লেগে ওর পোষাক অনেকটা ভিজে গেছে । আগমনীকে বললাম , আমি তোমাকে জানাতে চাই আমার অতীত ।”দীঘির বুকে বৃষ্টি পড়ার দিকে তাকিয়ে শুরু করলাম আমার আর উর্মিলার সমস্ত ইতিবৃত্ত । বৃষ্টি আরও জোরে পড়তে শুরু করেছে। মাঝে-মধ্যে দ’এক পশলা ঝড়ো হাওয়া ঝাউবন দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শন শন করে। এরই মধ্যে আগমনী মনোযোগ দিয়ে শুনছে উর্মিলা নামের একটি মেয়ের দূরন্ত ভালোবাসায় গাঁথা আমার স্মৃতিময় অতীত । আগমনীকে নলরাম , “ বৃষ্টি বুঁঝি আজ আর থামবে না । আশে- পাশে রিক্সা -টিক্সাও দেখছি না । চলো ভিজে ঝিজেই হলে যাই ।”আগমনী বললো বাকিটা শেষ করো । আমার কোনো ক্লান্তি লাগছে না। “ আমি শুরু করলাম...। শেষ পর্যন্ত আগমনীরই জিত হলো । আমি ঢাকায় ভর্তি হলাম । কলেজে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম প্রথম প্রচন্ড খারাপ লাগতো। ক্লাশে মনোযোগ দিতে পারতাম না,সারাক্ষণ ওকে নিয়ে ভাবতাম। সপ্তাহে দুটো করে চিঠি লিখতাম । ও লিখতো মাসে একটি । ওর বিরহে আমি কবিতা লেখা ধরলাম । বন্ধু মহলে আমি সেই কবিতা পাঠ করে হাস্য রসের খোরাক হলাম । সময়ের ব্যস্ত চাকা ক্রমেই আমাকে পড়াশোনায় ব্যস্ত করে তুললো। উর্মিলা একটি চিঠিতে জানালো , “ এমনিতেই তুমি পড়াশুনা নিয়ে এখন ভীষন ব্যস্ত । সপ্তাহে দুটো করে চিঠি লিখলে লেখাপড়া করবে কখন ? লক্ষীটি ,রাগ করো না।মাসে একটি করে চিঠি লিখো । আমি চাই তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ।” বিভিন্ন ভেকেশনে আমি বাড়ি গিয়ে সোজা ওদের বাড়িতে ছুটে যেতাম। আমাদের দূরন্তপনায় কখন যে ছুটি শেষ হয়ে যেতো টেরই পেতাম না । মনে মনে শিক্ষা জীবনকে গালিগালাজ করতাম । এইচ, এস, সি পরক্ষিা শেষ হলো। সামনে শুধু প্র্যাকটিক্যাল বাকি । ও মানবিক বিভাগের ছাত্রী হ্ওয়ায় ওর পরীক্ষা সম্পূর্ণ শেষ । প্র্যাকটিক্যাল শেষ হতে মাস খানেক সময় লাগলো্ । এরপর দিলাম বাড়িতে ছুঁট । বাড়িতে গিয়ে ল্যাগেজ -ব্যাগেজ ফেলে ছুটলাম উর্মিলাদের বাড়িতে । পথে স্কুলের বন্ধু অজয়ের সাথে দেখা । ওর চোখে মুখে লক্ষ্য করলাম ক্যামন একটা রহস্যের ছাপ। ও আজ ওর সহজাত ভংগিতে আমার সাথে কেনো যেনো কথা বলতে পারছে না । কথার মধ্যে কোথায় যেনো সৌজন্যতা আর সমবেদনার ছাপ। আমার বুকের মধ্যে ক্যামন করে উঠলো। আমি অজয়ের কাছে জানতে চাইলাম উর্মিলার খবর । ও আমার কাঁধে হাত রেখে আনত মুখে বললো , পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর উর্মিলার বাবা ওকে ওদের জ্যাঠা মশাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গেছেন। ফিরতে নাকি মাস দুয়েক দেরি হবে। আমার হাত-পা অসাড় হয়ে এলো । সম্ভাব্য সব জায়গায় পাগলের মতো ওর ঠিকানা খু৭জতে লাগলাম । কোথাও পেলাম না। মাস খানেক পরে উর্মিলার বাবা বাড়িতে এলেন । কিন্তু উর্মিলকোলকাতায় তার জ্ঞাতি ভাইয়ের ছেলের সাথে উর্মিলাকে বিয়ে দিয়ে এসেছেন। ও আর কখনও বাংলাদেশে আসবেনা। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম। দশ-পণের দিন কথা বলতে পারিনি । 


বুকের ভেতর প্রচন্ড এক পাথরচাপা কষ্ট আমাকে দুমরে- মুচরে দিতো। অথচ আমি একটু চিৎকার করে কাঁদতেও পারতাম না । আগমনী শুনে যাচ্ছিল। এ পর্যায়ে আমি আমার কান্না থামাতে পারলাম না । অনেকদিন পর আমি কাঁদলাম , শ্রাবণের অঝোর ধারায়। আগমনীও কাঁদতে শুরু করলো । আমার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললো , “ যদি অধিকার দাও , তোমার সমস্ত দূ:খ মুঁছে দেবো।” বৃষ্টি বুঝি আজ আর থামবে না । প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো । সিদ্ধান্ত নিলাম, ভিঁজে ভিঁজেই হলে ফিরবো । রাতে প্রচন্ড জ্বর এলো। ঠান্ডা লেগে সাইনুসাইটিসের ব্যথাটাও বেড়ে গেছে। গভীর রাতে একটু তন্দ্রার মতো এলো । তন্দ্রার ঘোরে স্বপ্নে দেখতে লাগলাম , “ কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ , কালো কো৭কড়ানো চুলের উপর লাল আর আকাশী রংয়ের কারুকাজ করা ব্যান্ড , গায়ে ধবধবে সাদা কামিজ আর পায়ে পেনসিল হিল পড়ে শ্যামলা, মায়াবী , ভিঞ্চির কারুকাজ করা লাস্যময়ী বদনের একটি মেয়ে কলা ও মানবিকী অনুষদের দিকে যাচ্ছে। তার পদভারে আন্দোলিত হলো পথের দু পাশের বৃক্ষরাজি। দুপাশের কাকচক্ষু দীঘি জল ছন্দিত হলো মৃদু কল্লোলে । অনুষদের সামনের ফুটন্ত ফুলগুলো ঝিকমিকিয়ে উঠলো ওদের পাঁপড়িতে শোভিত সলাজ শিশিরে। গত দুদিন ধরে জ্বর । জ্বর আর সাইনুসাইটিসের ব্যথায় বিছানায় পড়ে আছি। বেলা তিনটে বাজে। আকাশ মেঘলা, আবহাওয়া গুমোট , বেশ গরম পড়েছে । সকাল থেকে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘামে একেবারে নেয়ে উঠেছি। হল গার্ডের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। -----------”তন্ময় ভাই আপনার ফোন ।” অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙ্গে গেষ্টরুমে গিয়ে রিসিভার তুললাম । ফোনের ও পওান্ত থেকে ভেসে এলো আগমনীর মায়াবী কন্ঠস্বর -----হ্যালো ! কিছুক্ষন আগেও আকাশে ঘন মেঘ ছিলো্। গুমোট আবহাওয়া ছিলো। বিষন্ন ম্লান প্রকৃতির মাঝে রিক্ততার দাপাদাপি ছিলো । হঠাৎ কোথা থেকে এক পশলা শীতল বাতাস বিষাদের ঘন মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গ্যালো । এইতো, এইমাত্র আমার ভালো লাগার শুরু..... ।