গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ মে, ২০১২


ভ্রান্ত-মুক্তি
পৃথা রায় চৌধুরী
·
           মোবাইলটা চুপচাপ আমার পাশে শুয়ে আছে। একটু আগেই এসএমএস নিয়ে এসেছে। আমি খুনি। দূরে বসেই নিরীহ সুন্দর পাখিটাকে মেরে ফেললাম। ভাবছেন আমি পাগল ? আমি দীপ্তিমান - ২২ বছর বয়েস। বাড়ি নবদ্বীপ। সেখানে মা-বাবা, ভাইকে নিয়ে আছেন। আমি থাকি সোনারপুরের একটি মেসে। ওখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ি। বছরখানেক আগে সকলের দেখাদেখি ফেসবুকে একখানা প্রোফাইল বানাই ও মাঝেমাঝেই অন্তর্জালের আড্ডায় মশগুল হই, যদিও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়িনি। ভালই ছিলাম। মাঝেমাঝে একটা চিনচিনে দুঃখ ভেসে উঠত মনে...বৃষ্টি কে মনে পড়লেই। সে আমার প্রথম ভালবাসা ছিল; যদিও সে কোনোদিনই আমায় ভালবাসেনি।


এরকমই একদিন গত বছর মধ্য জুলাইএ নিজের প্রোফাইলে লগইন করে বন্ধুদের দেওয়াল পরিক্রমা করছি, এমন সময় চোখ আটকে গেল দুটো চোখের চাউনিতে। ছবির মধ্যে থেকে এত জীবন্ত ভাবে চেয়ে থাকা যায়, তা এই প্রথম বুঝলাম । বন্ধু হবার অনুরোধ পাঠাতে, তা মঞ্জুরও হল। এরপর শুধু রাইয়ের সাথে কথা। বলতে ভুলে গেছিলাম, ওর নাম রাই। কথায় কথায় জানলাম যে ও বিবাহিতা,এক ছেলের মা, আর ও আমার থেকে প্রায় এক যুগ আগে এই পৃথিবীতে এসেছিল। বুঝতাম সারাদিন আমি বকবক করি বলে মনেমনে বিরক্ত হত ও, কিন্তু আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সারাদিন ওর ইনবক্সে কথা বলতাম; ও কখনও উত্তর দিত, কখনও দিত না। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম ওকে ভালবাসি। ভাবলাম, এবার বুঝি বিতাড়িত হলাম, কিন্তু তা হলনা। ও শুধু চুপ করে গেল। পরের দু-তিন দিন ও আমার সাথে কোনও কথা বলল না। তারপর যেদিন কথা বলল, শুধু বোঝাতে লাগলো যে আমি ভুল করছি। রাই আমায় তাড়ায়নি, তার কারণ ও আমার কোনও ক্ষতি চায়নি...... ওর স্কুলের বন্ধু ছিলেন আমার শিক্ষিকা। কিন্তু আমি কি করব? ওকে হাজারটা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে লাগলাম যে এতে দোষের কিছু নেই। ওর মোবাইল নং চাইলাম; কিছুতেই দিলনা... উলটে বকল আমায়। ভীষণ কষ্ট হতে লাগল, প্রায় মাসখানেক ওর সাথে কথা বললাম না। কিন্তু একদিন ওর বার্তা এলো আমার ইনবক্সে। ও জানতে চাইল আমি কেমন আছি। সব অভিমান উগরে দিলাম উত্তরে। আর তখন রাই দিল নিজের মোবাইল নং ।

এরপর তো সব বাঁধ ভেঙ্গে গেল। ওর নাম দিলাম, পাখি। সারাদিন ধরে চলত শুধু কথা আর কথা, আর নিজের সংসারের সাথে আমাকেও সাঙ্ঘাতিক ভালবাসত। একটা অদ্ভুত আত্মসন্তুষ্টি আর ওর প্রতি টান অনুভব করতাম। ওকে বৃষ্টির কথাও বলেছিলাম; ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউতে চাকরি না পেয়ে বাবার কাছে বকুনি খেয়ে মাঝরাতে ওকে ফোন করে সারারাত কথা বলেছি । সব সহ্য করত ও । ওর ছেলের স্কুলের শীতের ছুটির সময় ওরা গেল কেরালা বেড়াতে। ওখানে থাকাকালীনও ও রোজ ফোন করে আমার খোঁজ নিত। এবার আমার একটা অপরাধবোধ জন্ম নিল। খালি মনে হত, নিজের ভালবাসার জন্য ওর সুখী জীবনটাকে তছনছ করে ফেলেছি।ওকে একদিন খুব শান্ত ভাবে আমি বললাম আমায় ভুলে যেতে, ও ভাবল ওর প্রতি আমার ভালবাসা শেষ। বহুকষ্টে ওকে সে যাত্রা সামলেছিলাম, নাহলে হয়তো ......।

ফেসবুকে আসা কমিয়ে দিলাম, ফোনে কথা বলা কম করলাম, এসএমএসও কমিয়ে দিলাম যাতে ও আমায় ভুলতে পারে; আমার কষ্ট হত ওকে এরকম করতে, কিন্তু ভাবতাম , এই ভালো। বুঝিনি ও আমায় ক্রমাগত আঁকড়ে ধরেছে এমনভাবে, যে আমার এসব উপেক্ষার ভান ও সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। আজ ৩০শে এপ্রিল... আমার জন্মদিন। পাখি আমায় ভালবাসার চরম উপহার দিয়ে উড়ে গেছে... " আমার গতবারের কেনা বিষ এবার কাজে এলো। ভালো থেকো।"


"আমায় ক্ষমা কোর সৌর, আমি তোমার যোগ্য ছিলাম না। তোমার সাথে আমি আরও একজনকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। তাই সরে গেলাম। তোজোকে মানুষ কোর আর ওকে কখনও জানতে দিও না তার মার মানসিক কলঙ্কের কথা......... রাই।"

পুলিশও তার চিঠি পেল..."আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় - রাই মুখার্জি।"



প্রতিদান
সায়ক চক্রবর্তী

ঘুমিয়েছিলাম অনেকক্ষণ। কখন যে অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছি হুঁশ নেই। চোখে তখনও ঘুম লেগে আছে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা বাচ্চা আমার কামরার দরজার পাশে বসে তার গায়ের নোংরা জামাটা খুলে ফেলল। খুলে কামরার মেঝে ওই পরনের জামা দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো। চোখ থেকে জল না বেরোলেও সামান্য একটু কষ্ট হল। সাফাই হয়ে গেলে লোকজন খুচরো পয়সা দিল। সে ওই পয়সাগুলো হাতের মুঠিতে খুব শক্ত করে চেপে ধরলও। এরপর জামাটা পরে নিল। এরপরের দৃশ্যটা আমি ভুলিনি বাচ্চাটা যতগুলো পয়সা পেয়েছিল সেগুলো বার বার করতে গুনতে শুরু করল দরজার পাশে বসে। দেখে মনে হল না যে গুনতে জানে না হয়তো আজ একটু বেশি কামাই হয়েছে আর তাই যাচাই করার জন্য বার বার করে গুনছে ! আমার কাছেও এসেছিল কিন্তু খুচরো ছিল না। একটাই দশ টাকার নোট ছিল বটে কিন্তু অত টাকা দিতে গায়ে লাগলো আর অন্যরা তো দিচ্ছেই !

ট্রেন থামল শেয়ালদা স্টেশনে, আমি লাগেজ নিয়ে নেমে গেলাম। একটা দোকানে এলাম সিগারেট কিনব বলে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানিব্যাগ উধাও! আমার তো তখন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাবার উপক্রম! কারণ ওই মানিব্যাগে ছিল আমার তিন হাজার টাকা, এ.টি.এম কার্ড আর ভোটার কার্ড। আমি দিশেহারা হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি সারা স্টেশন। এদিকে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে গন্তব্যে না পৌঁছলে আমার ব্যবসার বারো বেজে যাবে।

হঠাৎ দেখি সেই ছেলেটা দৌড়ে আসছে আমার দিকে । এসেই আমার হাতে মানিব্যাগটা গুঁজে দিয়ে বলল – ‘আপনার টাকা পরে গেসলো, আমি কামরায় পাইসি। আপনি তো নাইমে গেইলেন, তারপর আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে পাইলাম। কথাটা বলেই সে একটা ট্রেনের দিকে ব্যস্ত দৃষ্টিতে তাকাল, যেভাবে শকুন থাকে তক্কে তক্কে । আমি বুঝলাম এটা ওর পরবর্তী কাজের জায়গা মাথা নিচু করে মানিব্যাগটা খুলতেই দেখি সেই দশ টাকার একটা কোণ বেরিয়ে আছে । আমি বুঝে গেলাম এটা ওরই প্রাপ্য। ওকে টাকাটা দিয়ে ট্যাক্সি ধরলাম। এরপরেও অনেকবার ট্রেনে চেপেছি কিন্তু ঘুম ভেঙে আবার চোখ বন্ধ করে নিয়েছি