গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১২

'বিন্দে ' - সু ম ন ধা রা শ র্মা



                                 বিন্দে
                           সু ম ন ধা রা শ র্মা

     থমথমে স্টেশনচত্বর। রাতের মতো যে যার গন্তব্যে চলে গেছে। আরো কিছু লোক যারা আগের ট্রেনটা ধরতে পারেনি, তারা পরের কোনো ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত এখন অনেক, শীতশীত রাত, কালো অন্ধকার চুম্বকের মতো শীত টানছে। রেলের লোহার পাত সমান্তরাল মিশে গেছে একে অপরের সঙ্গে। আবার, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে একে অপরকে ছেড়ে চলে গেছে অনেকদূরে। স্টেশনচত্বরে জনাকুড়ি লোক। লাল-সবুজ আলো জ্বলছে এদিক সেদিক। স্বভাবতই মনে হবে, এটা কোন স্টেশন ? কোন লাইন ? এখান থেকে ট্রেনে চড়ে কোনদিকে যাওয়া যায় ? না, এসবের কোনো উত্তর আমি জানিনা। সোজাসুজি বলে দেওয়াই ভালো। কেননা, স্টেশনে কোন বড় আলো নেই। আর চারদিকে তাকিয়েও কিছুই বোঝার উপায় নেই। অতএব, আপনারা আপাতত এসবের কোনো উত্তর পাবেন না। কিন্তু, যদি কোনো সূত্র থেকে জানা যায় - এটা কোন স্টেশন , আমি অবশ্যই জানাবো ।
     একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট টানছে। যাকে বলে চেইন-স্মোকার। গলাবন্ধ সোয়েটার, ঘনরঙের পাতলুন, মাথায় টুপি। শুধু চোখদুটো আর ঠোঁট ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু, লোকটা ঘোড়েল, সেটা আলাদা করে বলে দিতে হবে না। এই লোকটাই আজ আমাদের বিষয়। এর নাম কি? এখন বলবো না। তবে, লোকটা সুবিধের নয় বলছি। আপনারা একে পারলে বাঁচিয়ে চলবেন। যাক, সিগন্যাল গ্রীন। তার মানে ট্রেন আসছে। একটা ধিকিধিকি আর সোঁ সোঁ আওয়াজ , ট্রেন আসছে। আসুক। আমার প্রয়োজন লোকটার গতিবিধি। লোকটা কোথায় যায়, কি করে, এইসব আর কি। গ্রাম্য লোকগুলো এতক্ষণে উঠে বসেছে। তারা বাক্স-প্যাঁটরা সাজিয়ে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। তারা এই ট্রেনের প্রতীক্ষায় এতক্ষ বসেছিল।
     ধকধক করে ট্রেন এসে থামল। ট্রেনের কামরায় কোনো আলো নেই। শুধু মাঝের প্যাসেজে একটা টিমটিমে আলো। লোকটা সিগারেট ফেলে উঠে পড়ল একটা কামরায়। ভেতরে দুএকজন যাত্রী ঘুমোচ্ছে। অনেক জায়গাই ফাঁকা । জানলা ফেলে লোকটা একটা কোনার সিটে বসে পড়ে। আবার একটা সিগারেট ধরায়। লম্বা টানে। ও আমাকে দেখতে পাচ্ছেনা । তাই আমি এখানেই বসব। ট্রেন ছেড়ে দেয়। হুইসল দিয়ে। ধকধক করে চলতে শুরু করে বিশাল সাপের মতো। মাঝে মাঝে শুধু সোঁ সোঁ শব্দ। আমার নিশ্বাস পড়ছে না। পড়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আমি নিশ্বাস নিই না। আর ঐ লোকটাও না। শুধু সিগারেট টানে। শুধু সিগারেট। একটা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে ট্রেন। চলছে তো চলছেই। জঙ্গল এবং ট্রেন। কিন্তু না। ট্রেন থামছে। এখানে তো থামার কথা না। কেউ চেইন টেনেছে ? কে ? এই মধ্যরাতে কার শখ হলো জঙ্গল দেখার । যদিও অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। লোকটা ব্যস্ত হয়ে হয়ে উঠছে। হাতের প্যাকেটটা সিটের নিচে চালান করে দিয়ে সিটটা পাল্টায়। আমি দেখছি। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ও ভয় পেয়েছে। আর , এবার কি করে সেটাই দেখবো। তার আগে চুপি চুপি বলে রাখি, চেইনটা কিন্তু আমি-ই টেনেছি। সে তোমরা বিশ্বাস করো বা না করো, আমার কিছু যায় আসে না।
     কয়েকটা লোক অন্ধকারের মধ্যে থেকে উঠে এল ট্রেনের কামরায়। তাদের মুখঢাকা, হাতে চকচকে ধারালো ভোজালি, কাতানজাতীয় অস্ত্রশস্ত্র। তারা কাউকে খুঁজছে। ট্রেনে ? কে এমন আছে, এই অন্ধকার কামরাতে? আমি নই তো? অবশ্য, আমাকে খুঁজে পাবার ক্ষমতা ওদের নেই। আর, সেই চেইনস্মোকার লোকটাকেও না। আমি তাই একটু সরে বসি, যাতে ব্যাপারটা দেখা যায় ঠিকঠাক । সেই চেইনস্মোকার এখন টয়লেটে ঢুকেছে। মুখঢাকাদের একজন সিটের তলাগুলো খুঁজতে শুরু করে। আর বাকিরা টহল দিচ্ছে সারা কামরায়। চেইনস্মোকারের সিটের তলায় হাত বাড়িয়ে লোকটা একটা পুঁটুলি মতন কি বের করে।
-         পেয়েছি। খবর ঠিকই ছিল। চল। অপারেশন সাকসেসফুল।
-         শালা, এত তাড়াতাড়ি পাবি , ভাবিনি। ট্রেনটাকে ছেড়ে দিতে বলি, বসন্ত ?
-         ভাগ, শালা। নাম নিচ্ছিস কেন ? পোস্টারগুলো কোথায় ? ছড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে আয়। আর, একটা বোমচার্জ কর। নাহলে, না ঠিক জমে না। হে হে হে...
লোকগুলো নেমে গেল কামরা থেকে । একটা বোমচার্জ হল। আর, টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে কামরা থেকে নেমে গেল চেইনস্মোকার। আমি একাই বসে আছি। আর, দেখছি, মালটা এখনও সেরকমই রয়েছে। একটা গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে গলা ছেড়ে...‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি’।
     আস্তে আস্তে ট্রেন নিজের গতি ধরছে। আমিও ঘুমিয়ে প’ড়লাম। কেননা, আমার কাজও শেষ। আমার বন্ধু ট্রেন থেকে নামার আগে বলে গেছিল,‘ভাল থাকিসরে বিন্দে’!
বিন্দে ? কন্ট্রোভার্সির একটা সিজন্‌ড্‌ নাম। অথচ, কোনো শব্দ হয় না। মারকাটারী খবরের কাগজের লোক খবর রাখে না। কারা এল, কারা গেল - এর কোনো হদিশই দেয় না আমি ঘুমিয়ে যাবার আগে যে লোকটা টুক্‌ করে নেমে গেল ট্রেন থেকে, সে এর অনেককিছুই জানত। অথবা, জানত না। তাতে কারো কিছু যায় আসে না। আমারও না। কেননা, আমার জন্য এই মাঝরাতে জঙ্গলে ট্রেন থামে। যদিও তাতে আমার বিন্দুমাত্র গর্ববোধ হয় না। জ্বালাও ধরে না। যদিও কালো অন্ধকার এখনো এসে কিছু জোনাকি পাঠিয়ে দেয় আমার স্বপ্নে। কখনো কখনো মনে পড়ে, একদিন একটা লোকের একটা নাম ছিল, ঘর ছিল, কাজ ছিল। আজ পকেটে নিশ্বাস পর্যন্ত নেই। টাকা পয়সা, চালচুলো সব গেছে। আগে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকত। আজ ডাকে কিনা বুঝতে পারিনা। যদিও, মাঝেমধ্যে আমার বন্ধুদের কেউ কেউ এসে পুরনো নামটা মনে করিয়ে দিয়ে টুক্‌ করে নেমে যায় ট্রেন থেকে। তারা স্টেশনে নামে না। কোনো স্টেশন তাদের অভিধানে নেই। কোনো স্টেশনে তাদের খোঁজ পাওয়ার কথা নয়। তারা নেই। তাদের থাকার কথাও ছিল না কখনো।
(সৌজন্য : ফোকাস ত্রিপুরা.কম)