গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১১

একটি নাটকের খোজে
  ফা ল্গু নি মু খো পা ধ্যা য়

       




কাহিনির সবটাই ডাক্তার নন্দীর কাছ থেকে শোনা । ডাক্তার ভোলানাথ নন্দী- বছর পাঁচেক হবে বোধহয়, এপাড়ায় ফ্ল্যাট নিয়েছেন । মফঃস্বলের এই আধা গ্রাম –আধা শহরের আটপৌরে লোকজনের মাঝে ডাক্তার নন্দী বেশ বড় মাপের লোকই বলতে হবে । আধা গ্রাম হলে কি হবে, বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি গজাতে তো বাধা নেই, গজিয়ে উঠছেও অনেক । শুনেছি মনরোগের চিকিৎসক, তবে এপাড়ায় তাঁর কোন চেম্বার নেই, থাকার কোন কারনও নেই । বেশ রাশভারি মানুষ, শুনেছি আগে দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর না কোথায় থাকতেন ।


গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ডাক্তার নন্দী, পাড়ায় বেশি মেলামেশা  ক’রতেন না, মানে পাড়ায় দুর্গা পুজো বা কোন অনুষ্ঠানে তাকে খুব বেশি দেখা যেত না, তবে আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল । কেন জানিনা আমাকে খুব ভালোবাসতেন । মাঝে মধ্যেই আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন, গল্প করতেন , আমাকে ডেকে পাঠাতেন । কিন্তু কোনদিন তাঁর পারিবারিক ব্যাপারে কোন কথা বলতেন না , শুধু জেনেছিলাম তাঁর একমাত্র ছেলে, আমার বয়সী বাইরে ডাক্তারী পড়ছে । আমি একটু আধটু নাটক-থিয়েটার করি আর সেই সূত্রেই ডাক্তার নন্দীর সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল ।


ডাক্তার নন্দী তখন এ পাড়ায় নতুন এসেছেন । আগের দিন পাড়ার রবীন্দ্র ভবনে আমার লেখা একটা নাটক অভনীত হয়েছিল, আমি সকালে রাস্তার মোড়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম, ডাক্তার বাবু রিকশতে আসছিলেন – বোধয় বাজার করে ফিরছিলেন । রিকশ থামিয়ে কাছে এলেন, বললেন কাল তোমার নাটকটা দেখলাম, একদিন এসো আলাপ করবো । আমি অবাক হলাম, আজকাল বাড়িতে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড দিয়ে এলেও টেলি সিরিয়াল ছড়ে লোকে নাটক দেখতে আসে না , আর ডাক্তার বাবুর মত ব্যস্ত লোক নিজে থেকে আমার নাটকটা দেখতে এসেছিলেন ! ডাক্তার বাবু বলেছিলেন ‘এমনিতে নাটক-টাটক দেখার সময় পাই না কিন্তু তোমার নাটকের – কি যেন নাম – ‘এখন অসুখ’ তাইতো’ ? আমি ঘাড় নাড়লাম , ডাক্তার বাবু বলেছিলেন ‘হ্যা, ওই নামটাই আমাকে আকর্ষণ করলো, আসলে আমি তো ডাক্তার, তাই ভাবলাম দেখি নাট্যকার কোন অসুখের কি ডায়াগনোসিস করেছে’ ।


অবাক হলাম আবার ভালোও লাগলো । নাটকটা ছিল এক প্রবীণ দম্পতির আত্মযন্ত্রণার ছবি । তাদের একমাত্র সন্তান বিদেশে চাকরী করতে গিয়ে সেখানেই থেকে গেছে । বিয়ে করার পর গত পনেরো বছরে একদিনের জন্যও বাবা মাকে দেখতে আসেনি । টাকা পাতঠায়, ফোন করে, খবর নেয় কিন্তু একদিনের জন্যেও সার সময় কিংবা ইচ্ছা হয়না । এদিকে মা’র মৃত্যু হয়, খবর যায় । ছেলে আসবে বলে বৃদ্ধ বাবা একদিন মৃতদেহ রেখে দেন,ছেলে তার গর্ভধারিনীকে দেখতে আসবে। কোন ফ্লাইটে আসবে ছেলে তাও জানিয়েছে । বাবা পথ চেয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ মুহুর্তে ছেলের বদলে আসে একটা ফোন – ‘বাবা, কাজের চাপে যেতে পারছি না , টিকিট ক্যান্সেল করেছি’ ।


তবে কি ডাক্তার বাবু আমার নাটকে নিজেকে খুঁজতে চেয়েছিলেন ? ভাবলাম, কিন্তু ডাক্তার বাবুর ছেলে তো বিদেশে পড়ে না ! সেদিন ডাক্তার বাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম, পরে আরো অনেকবার । ডাক্তার বাবুও আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলেন । একদিন ডাক্তার বাবুকে বললাম ‘ ডাক্তার বাবু, আপনি তো মনের নানান জটিল রোগের চিকিৎসা করেন, আপনার কেস স্টাডি থাকে একটা গল্প বলুন না, যা থেকে একটা নতুন নাটক লিখতে পারি’ । ডাক্তার বাবু মিনিট খানেক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা পুরোনো খবরের কাগজ আমাকে দিয়ে বললেন পড়ো । দেখলাম কাগজের তারিখটা ১৬ই এপ্রিল ২০০২। একটা সংবাদে দাগ দেওয়া রয়েছে, পড়লাম ।  ক্লাস সেভেনের একটা ছেলে তার সহপাঠীকে চেয়ারে বেঁধে গলা টিপে খুন করেছে । যকে মেরেছে সে ওর স্কুলেরই ফার্স্ট বয় ছিল , খুনি ছেলেটিও খুব মেধাবি ছাত্র ছিল, তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ । এইটুকুই মাত্র ছিল খবরটা । ঘটনাটা আমি জানতাম, কাগজে দেখেছিলাম, তখন সবেমাত্র মাধ্যমিক পাশ করেছি, তারপর ভুলেও গেছি । এমন ঘটনা এতো ঘটছে যে তা জেনে কেউই আর তেমন বিচলিত হয়না, আমিও হইনি ।
       
আমি বললাম ‘কিন্তু ডাক্তার বাবু, এইটুকু মাত্র কাহিনি নিয়ে নাটক হবে কি করে ? নাটকীয়তা কোথায়’ ? ডাক্তার নন্দী মনে হলো সামান্য উত্তেজিত হলেন ‘কি বলছো তুমি নাট্যকার , নাটকীয়তা নেই ? একটা এগারো বছরের নিষ্পাপ শিশু তার সহপাঠীকে খুন করলো, নাটকীয়তা নেই ? সমাজের কোন গভীর অসুখ তাকে দিয়ে একাজ করালো, নাটকীয়তা নেই বলছ’ ? আমি বললাম না, মানে পরের ঘটনা গুলো না জানলে...’ , কথাটা শেষ হল’না, ডাক্তার বাবু বললেন ‘বলবো, সব বলবো , তবে আজ নয়’, এই একটিমাত্র কেসই আমি স্টাডি করছি বারো বছর ধরে’


সেদিন চলে এলাম, অনেকগুলো ছবি মনে ভীড় করলো । কি হ’ল ছেলেটির, সে কি পেশাদার অপরাধী হ’য়ে গেলো ? তার মা, তাঁরই বা কি পরিনতি হলো ? আবার নিজেকে তিরস্কারও করলাম , দূর! আমি কি জম্পেশ টেলি সিরিয়াল লিখছি নাকি ! আমার মস্তিস্ক জুড়ে ঐ কথাটা ঘুরপাক খচ্ছে, সমাজের এ কোন গভীর অসুখ ! কার পাপে একটা নিষ্পাপ শিশু খুনি হয়ে যায় !ক’দিন পরে ডাক্তার বাবুর ডাক পেয়ে গেলাম । ‘তোমাকে খুব দরকার, আমার একটা উপকার করতে হবে , আমার কাজে লাগবে তোমার সাহায্য’ । আমি বুঝতে পারলাম না আমার মত একটা থিয়েটার করা তরুণ অত বড় মাপের চিকিৎসকের কি কাজে লাগবো । বললেন ‘তোমাকে একটু অভিনয় করতে হবে, দশ পনেরো মিনিট । আমার চিকিৎসার কাজে তোমার এই দশ পনেরো মিনিটের অভিনয়টা খুব কাজে লাগবে । বিশেষ একজনের চিকিৎসার এটাই শেষ ধাপ হতে পারে , আমি নিশ্চিত এই শেষ ধাপটা পেরোলে রোগী হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে, ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাবে’ । আমি বললাম ‘কিন্তু ডাক্তার বাবু, আমার নাটকের কাহিনিটার কি হবে, আজকে বলবেন নয়া’ ? বললেন ‘হ্যা হ্যা আজই বলব, মাত্র আট-দশ মিনিট, আমাকে আমার চিকিৎসার শেষ ধাপটা পেরোতে দাও ।
       
আমি সম্মোহিতের মত শুনে যাচ্ছিলাম, ডাক্তার বাবু আমাকে দিয়ে কি করতে চাইছেন ? ডক্তার বাবুর কথায় হুঁশ ফিরল, ব’ললেন, শোন,’আমি একজনকে নিয়ে আসছি, তোমার কাকিমার যা বয়স হওয়া উচিত সেই বয়সী, তুমি তার ছেলের বন্ধু আজই দেরাদুন থেকে এসেছ’একটা সাদা খাম আমার পকেটে দিয়ে বললেন ‘চিঠিটা ওর হাতে দেবে, কোন প্রশ্ন করলে ইতিবাচক উত্তর দেবে , হ্যা, বলা হয়নি ও কিন্তু চোখে দেখতে পায় না , ঠিক আছে ? আমি আসছি’এক সুদর্শনা মহিলাকে নিয়ে ভেতরে এলেন , সত্যিই কাকিমা বলে ডাকতে ইচ্ছা হ’চ্ছিল – অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী চেহারাডাক্তার বাবু বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন ‘দেখ সুপর্ণা, শুভর বন্ধু এসেছে, শুভ পাঠিয়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে’ । আমি নিপুন অভিনেতার মত প্রণাম করলাম, উনি বললেন ‘তুমি শুভর বন্ধু ? শুভ কেমন আছে ? পরীক্ষাতে ফার্স্ট হয়েছে তো ?’ আমি বললাম হ্যা কাকিমা প্রত্যেক বছর ওই তো ফার্স্ট হয়, এবারও হয়েছে , ও ছাড়া আর কে ফার্স্ট হবে ?’ উনি বললেন ‘ঠিক বলেছ, জান কত বকতাম – বলতাম তোমাকে সমস্ত পরীক্ষায় ফার্স্ট হ’তে হবে, ও কথা রেখেছে । কিন্তূ কবে আসবে শুভ কিছু বলেনি’ ? স্টেজে মেকাপ করার মত আমি বললাম ‘ এই তো সামনের পূজোর ছুটিতেই আসবে বলছিল , আপনাকে একটা চিঠিও দিয়েছে ‘ বলে পকেট থেকে সাদা খামটা ওনার হাতে দিলাম । বললেন ‘শুভ চিঠি দিয়েছে ? ওতে লেখা আছে পূজোর ছুটিতে আসবে ?’ বললাম ‘হ্যা সে রকমই তো বললো’ । উনি চিঠিটা বুকে চেপে ধরলেন । আমি মঞ্চে অভিনয় করি , কিন্তু ছেলের জন্য দৃষ্টিহীন মাএর এমন দুর্বল করে দিল বইকি ! আমাকে আর বেশিক্ষণ অভিনয় করতে হ’লনা , ‘এবার তুমি ভেতরে যাও সুপর্ণা । শুভর বন্ধু এখনো নিজের বাড়িতেই যায়নি , অনেক দূর যেতে হবে’ । উনি বললেন ‘যাও বাবা, শোন, তুমি ফিরে যাবার আগে, একবার দেখা করে যেও, শুভর জন্য আলুর চিপস কিনে রাখবো নিয়ে যেও, ও আলুর চিপস খেতে খুব ভালোবাসে’ডাক্তার বাবু ওনাকে ভেতরে রেখে এলেন ।
                
আমি বুঝলাম আজকে আর গল্পের শেষ টুকু শোনা হবে নাবললাম, ডাক্তার বাবু আজ তবে আমি যাই । উনি বললেন, আরে বোস বোস গল্পের বাকিটা শুনবে না ? আমি ব’সলাম, ডাক্তার বাবু ব’লে চললেন । ‘ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, কিন্তু শুধু ভালো হ’লেইতো হবে না, ওর মা চাইতো ওকে ফার্ষ্ট হ’তে হবে প্রতিটি পরীক্ষায়, সব কিছুতেই । খেলা ধুলো ছবি আঁকা সব বন্ধ – শুধু দৌড় ফার্ষ্ট হওয়ার জন্য । সেবার ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষায় ছেলেটি সে্কেন্ড হয়েছিল । ওর মা খুব বকাবকি করেছিল , গল্পের বই, ছবি আঁকার সরঞ্জাম – সব ফেলে দিল , শুধু স্কুলের বই পড়তে হবে আর ফার্ষ্ট হ’তে হবে । ছেলেটির মা’র এই বিকৃত মানসিকতার দাবি মেটানোর চাপ ওইটুকু ছেলে সামলাবে কিকরে ? তাই তার সহপাঠী যে বরাবর ফার্ষ্ট হ’ত তাকেই সরিয়ে দিল গলা টিপে খুন করে’ । আমি শুধু বললাম ‘তারপর’ ? ডাক্তার নন্দি ব’লে চললেন ‘জুভেনাইল কোর্টের বিচারে সাজা হ’য়েছিল মাত্র পাঁচ বছর –সব কথা অকপটে স্বীকার করেছিল বলে । খুব মেধাবী ছিল, সংশোধনাগারে পড়াশোনা ক’রে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে, তারপর জয়েন্ট এনট্রান্সে সফল হ’য়ে এখন ডাক্তারি পড়ছে । এই বারোটা বছর ছেলেটি তার মাকে দেখেনি । পূজোর ছুটিতে যদি আসে...’। আর বললেন না । দেখলাম, আপাত কঠিন মনের ডাক্তার নন্দীর  চোখ জলে চিক চিক করছে ।
     
জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি সেই ছেলেটারও মানসিক চিকিৎসা করেছিলেন ? ব’ললেন ‘না, তার তো চিকিৎসার দরকার ছিল’না, চিকিৎসার দরকার ছল তার মা’র, বারো বছর ধরে আমি তারই চিকিৎসা করে চলেছি, ক্রমেই সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে’ ।
       
         ‘আর সেই ছেলেটি’ ? আমি কৌতুহল চাপতে পারলাম না । ডাক্তার নন্দী আমার মুখের দিকে তাকালেন, বললেন ‘সেই ছেলেটিই শুভ – শুভঙ্কর , একটু আগে তুমি যার বন্ধুর অভিনয় করলে । শুভঙ্কর আমারই ছেলে’ । এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা আমাকে আচ্ছন্ন ক’রলো শুধু ডাক্তার বাবুর কথা শুনছি –‘আর যাকে তুমি শুভঙ্করের বন্ধু হ’য়ে প্রণাম ক’রলে সে শুভঙ্করেরই মা, ১২ বছর ধরে আমি যার মনের জট খোলার চেষ্টা ক’রে চলেছি’ । আমি কয়েক মিনিট কোন কথা ব’লতে পারলাম না । ডাক্তার বাবুর কথায় ঘোর কাটলো । ‘এবার তবে এসো, অনেকক্ষণ তোমাকে আটকে রাখলাম’ । আমি উঠলাম, শুধু অস্ফূট স্বরে ব’ললাম ‘ ‘কাকিমা সম্পূর্ণভালো হয়ে উঠবেন তো’ ?
       
ডাক্তার বাবু ব’ললেন ‘হ্যা, আশাতো করছি শুভ এসে সম্পূর্ণ সুস্থ মাকে দেখতে পাবে । তবে –‘ ভারি হয়ে আসা কন্ঠে বললেন দুঃখ একটা থাকবে যে ছেলেকে সে দেখতে পাবে না স্পর্শ ক’রতে পারবে মাত্র । মাঝে মাঝে এসো, শুভ বন্ধু হয়েই এস , তোমাকে স্পর্শ ক’রে হয়তো তোমার কাকিমা আর একটু তাড়া তাড়ি ভালো হয়ে উঠবে । আর হ্যা, নাটকটা লেখা হলে আমাকে পড়াবে’ । ‘আসবো, নিশ্চয় আসবো’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম ।
     
রাস্তায় বেরিয়ে নিজেকে ব’ললাম – লিখবো, নাটকটা লিখবো । কিন্তু কাকে নিয়ে ? সমাজের গভীরতর অসুখের বিরুদ্ধে ডাক্তার নন্দীর নিঃশব্দ সংগ্রাম না কি সেই গভীর অসুখের মুখে লাথি মেরে নিজের সহপাঠীকে খুন করা সেই ছেলেটির ডাক্তার শুভঙ্কর নন্দী হ’য়ে ওঠার কথা ?
                                                               =====
                

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১১


নীলমণি ও সত্যপ্রকাশ





ত্যপ্রকাশকে নিয়ে কিছু লেখার আগ্রহ বা ইচ্ছে কিছুই ছিল না , বরং নীলমণিকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবছিলাম । নীলমনি মহাতো – পুরুলিয়ার এক গন্ডগ্রামের আদিবাসী লোকশিল্পী । আমি তখন রাড় বাংলার লোকগান নিয়ে একটা কাজ করছিলাম , সে কাজেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে যেতাম প্রায়ই তখনই নীলমণির সঙ্গে আলাপ হয় । পুরুলিয়ার রুখা শুখা মাটি থেকে সুর তুলে আনত নীলমনী । ওকে একদিন বলেছিলাম কলকাতায় একদিন প্রাণভরে তোমার গান শুনবো নীলমনি । নীলমনি বলেছিলো, কলকাতার জলসায় আমি গান গাইবোনা, টাকা দিলেও না । বলেছিল, শহরে ইট কাঠের জঙ্গলে মানুষের প্রাণের মধ্যি কোনো সুর লাই গো দাদা । বলেছিল, ইদিকটা একতু শান্ত হোলি, এস আমার কুঁড়ে ঘরে বসে তোমায় প্রাণ ভরে গান শুনাবো ।
না, নীলমণি আর কোনদিন গান শোনাবে না আজকের কাগজে ছোট করে একটা সংবাদ বেরিয়েছে , পুরুলিয়ার লোকসঙ্গীত  শিল্পী নীলমনি মাহাতো খুন হয়েছে, রাস্তার ধারে তার কন্ঠনালী কাটা লাশটা পাওয়া গেছে । কারা নীলমণিকে খুন করেছে তার ইঙ্গীতও সংবাদ পত্রটি দিয়েছে । এখন অবশ্য রাস্তার ধারে খুন হয়ে পড়ে থাকা লাশ কোন দুর্লভ দৃশ্য নয় । বিচলিত আমি ভেবে পাইনা বেঁচে থাকার জন্য মানুষ আর কত মূল্য দেবে ! কিন্তু নীলমণির এলাকা তো গান, সেই এলাকায় ঢুকতে তো মোটর সাইকেল চেপে আসতে হয় না !
       
ঠিক এই সময় আমার সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়বার ইচ্ছে হলো । ও কি আমার মতই বিচলিত হয়েছে ? নাকি বিচলিত হওয়ার মত মন এখনো ওর আছে ! সত্যপ্রকাশ কলকাতার একডাকে চেনা নাট্য ব্যক্তিত্ব , মিডিয়া ইদানিং একটা অলঙ্কার লাগিয়েছে ‘সেলিব্রিটি’ তা সে আমার বন্ধুও বটে , অন্তত দু বছর আগে পর্যন্ত ছিল । শুনতে পাই এখন সত্যপ্রকাশ আমাকে ‘দালাল’ ছাড়া আর কিছু ভাবেনা , তা ভাবুক, কিন্তু সত্যপ্রকাশের নাট্যবোধ ও অভিনয় দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এখনো অটুট । ইদানিং অবশ্য সত্যপ্রকাশ থিয়েটারে আর সময় দিচ্ছে নয়া, এখন টেলিভিষণে ওর খুব চাহিদা, নানান কারেন্ট এফেয়ার্স ওনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠনের মোমবাতি মিছিলেও দেখা যায় সামনের দিকে ।


বছর তিনেক আগে আমিই নীলমণিকে সত্যপ্রকাশের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম । পুরুলিয়ার লোক শিল্পীদের জীবন নিয়েরুক্ষ মাটির গাননামে একটা নাটক করার কথা সত্যপ্রকাশ আমাকে বলেছিল নাটকটাতে সুর ও গান করার জন্য আমি নীলমণিকে রাজি করিয়েছিলাম রুক্ষ মাটির গানদারুন হিট করেছিল ও আমাকে বলেছিল যে এই নাটকটাই ওর সচেয়ে সফল প্রযোজনা এবং নীলমণির গানের জন্যই যে সেটা সম্ভব হয়েছল, সত্যপ্রকাশ তাও জানিয়েছিল সেই নীলমনির খুন হয়ে যাওয়ার খবরটা সত্যপ্রকাশ নিশ্চয়ই পেয়েছে আমি মনে মনে সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করতেই আর একটা দৃশ্য ভেসে এলোনীলমনির জন্য নাটক ও সঙ্গীত জগতের লোকেরা মোমবাতি মিছিল করছে, আমি মিছিলে সত্যপ্রকাশের মুখটা খুঁজছি তন্নতন্ন করে
          
আচমকা টেলিফোনের তীব্র শব্দে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল ফোন তুললাম অবাক বিস্ময়ে শুনলাম ওপারের কন্ঠ – ‘মণীষ, আমি সত্যপ্রকাশ বলছি আমার গলা দিয়ে আপাতত কোন শব্দ বেরোলো না প্রায় দু বছর বাদে সত্যপ্রকাশ আমাকে ফোন করছে , ভেবে পেলাম না কি এমন ঘটনা ঘটল যে দালাল হয়ে যাওয়া আমাকে ওর দরকার পড়লো ? ওপারে কন্ঠে একটা আকুতিএকবার আসতে পারবি’ ?
          
আমি ? কি ব্যাপার ? আমি জানতে চাইলাম । ও বললো, তোকে ছাড়া কাউকে বলা যাবে না আমি বললাম, কিন্তু ব্যাপারটা কি তাতো জানতে হবে । সত্যপ্রকাশের কন্ঠস্বর একটু বিচলিত মনে হল, বললো, ‘হ্যা মানে সেই নীলমণি মাহাতো ...’ ।  ‘জানি, গতকাল রাত্রে নীলমনি ......’ খুন হয়েছে কথাটা বলার আগেই সত্যপ্রকাশ বললো ‘গতকাল গভীর রাতে নীলমণির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, ও আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল, আমি উত্তর দিতে পারিনি ।‘
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে নয়া, কি বলছে সত্যপ্রকাশ ? খুন হওয়ার তারিখে গভীর রাতে নীলমণি সত্যপ্রকাশের সঙ্গে দেখা করেছিল – এ কি করে সম্ভব ? খবরের কাগজ তো জানিয়েছে নীলমণি রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে খুন হয়েছে , তা ছাড়া এদিন ই তো সত্যপ্রকাশের একটা সম্বর্ধনা অনুষ্টান ছিল , কোন এক মানবাধিকার সংগঠন ওকে সম্বর্ধনা দিচ্ছিল । দিনটা রবি বার ছিল , আমি সত্যপ্রকাশের ফ্ল্যাটে গেলাম ।
          
সত্যপ্রকাশ আমাকে যা বললো তা এই রকম । নীলমণির খুন হওয়ার দিন ওর ঘরে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়েছিল । সম্বর্ধনার পর খাওয়া-দাওয়া ছিল,পেটে একটু্ তরল পানীয়ও ঢুকেছিল  । গলির মোড়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে টলমল পায়ে হাঁটছিল সত্যপ্রকাশ , হঠাত অন্ধকার ফুঁড়ে একটা কালো মত লোক ওর কাছে এগিয়ে এসে বললো - আমি নীলমণি মাহাতো বটে গো দাদা চিনতে পারছো ? চিনতে পেরে সত্যপ্রকাশ বলেছিল , এত রাতে তুমি এখানে কি করে এলে নীলমণি ? তবে যে কাগজে দেখলাম ......, ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলমনি বলেছিল- ও কথা থাক দাদা, আমি একটা প্রশ্ন শুধোতে এইছিলুম গো । তুমিতো আমাদের ওখেনে মিটিন করতে গ্যাছিলে সেদিন , তা নীলমণি কেমন আছে একটুন খোজ করলেনা কেন গো দাদা ? একজন সুরের কারবারীকে খুন হতে হয় কেন গো দাদা ? সত্যপ্রকাশ চিৎকার করে উঠেছিল ‘তাহলে খবরটা সত্যি ? তুমি ......! নীলমণি বলেছিল ‘ একটুন আগে তুমি যখন মিটিনে পুরুলিয়ার মানুষদের নিয়ে বলছ্যালে – ঠিক তখনই তোমার নাটকের নীলমণি মাহাতোর কন্ঠনালী কাটা লাশটা ওরা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল । কেন গো দাদা, কোন বিপ্লবের দাম চুকোচ্ছি গো আমরা ?’ সত্যপ্রকাশের আর কিছু মনে ছিলনা । কখন কি ভাবে ঘরে ঢুকেছিল, তাও নয়
          
বিবরনটা শুনে আমি আর একবার ওর ভেতরটা পড়বার চেষ্টা করলাম, কেননা মদের ঘোরে অন্তত নীলমণির কথা্টা ভেবেছিল সত্যপ্রকাশ , নীলমণির খুন হওয়াটা ওর ভেতরটাকে হয়তো কিঞ্চিৎ আলোড়িত করেছে । চলে আসার আগে বললাম, তুমি আবার ‘রুক্ষ মাটির গান’ নাটকটা করো, নীলমণি না থাকুক, তার সুর আর গানগুলোতো আছে ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো টেলিফোনের শব্দে । ঘুম মাখা চোখে ফোন তুললাম । ওপারের কন্ঠ বল - যাদবপুর থানা থেকে সার্কেল ইন্সপেক্টর সুজয় বোস বলছি স্যার । শান্ত গলায় বললুম ‘বলুন’ । সুজয় বলল – ‘প্রবীণ নাট্যকার – পরিচালক সত্যপ্রকাশ কাল রাত্রে আত্মহত্যা করেছেন, আপনি একবার আসতে পারবেন স্যার ? আপনাকে লেখা একটা চিরকূট রেখে গেছেন’ ।আমি আধঘন্টার মধ্যে পোঁছে গেলাম । সত্যপ্রকাশের মুখে গ্যাঁজলা ওঠা নিথর দেহটা পড়ে আছে, পাশে শূণ্য ঘুমের ওষুধের শিশিটা রয়েছে । সুজয় একটা চিরকূট বাড়িয়ে দিল । রাত্রি দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে লেখা একফালি কাগজে সত্যপ্রকাশ লিখেছে ‘মণীষ, তোর কথাটাই ঠিক , বাঘের পিঠে ওঠাটা সহজ, নামাটা কঠিন , তাই ...... ‘।
                                 ----------------